প্রায় পৌনে ৪০০ বছর আগে পুরান ঢাকার ছোট কাটরায় বসে বাংলা শাসন করতেন মোঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ। বলা হয়ে থাকে তার আমলেই টাকায় আট মন চাল পাওয়া যেত। মূলত শরাই খানা বা প্রশাসনিক কাজে জন্য শায়েস্তা খাঁ এটি নির্মাণ করেছিলেন। বড় কাটারার পূর্বদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই স্থাপনাটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় আনুমানিক ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালের দিকে। আর শেষ হতে সময় নিয়ে ছিল প্রায় ৭ বছর। দেখতে অনেকটা বড় কাটরা মতো মনে হলেও আকৃতিতে কিছুটা ছোট হওয়ার কারনেই হয়তো এর নাম ছোট কাটারা। বতমানে এ অবস্থা খুবই করুন। এখন আর দেখে বোঝার উপায় নেই এটি মোগল আমলের একটি স্থাপত্য।
ইমারতটি মধ্য এশীয় সরাইখানার ঐতিহ্যবাহী প্যাটার্ন অনুসরণ করে এবং মোগল স্থাপত্য অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে। বড় কাটারার মতো ছোট কাটারাতে ও ছিল দুটো তোরণ বা ফটক, একটি উত্তরে পাশে ও অপরটি দক্ষিণে পাশে। দক্ষিণের ফটকটিই ছিল প্রধান ফকট। আয়তাকার কাটারার দক্ষিণ বাহুর দুই কোণায় দুটো আটকোণা টাওয়ার ছিল।
১৮৬১ সালে ইংরেজ মিশনারী খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক লিওনার্দ ছোট কাটারায় খুলেছিলেন ঢাকার প্রথম ইংরেজী স্কুল। ১৮৫৭ সালে এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয় ঢাকার প্রথম নরমাল স্কুল। উনিশ দশকের শেষ বা বিশ দশকের শুরুতে ছোট কাটারা ছিল নবাব পরিবারের দখলে। ১৬৭১ খ্রিষ্টাব্দ শায়েস্তা খাঁ ছোট কাটরার ভেতরে চম্পা বিবির সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন। সমাধিসৌধ চম্পা বিবির মাজার নামেই বেশি পরিচিত। পুরনো ঢাকার চকবাজার থানার সোয়ারী ঘাটের চম্পাতলী এলাকার নামকরণ করা হয় চম্পা বিবির নামানুসারে। বিবি চম্পা কে ছিলেন তা সঠিক ইতিহাস জানা যায় না।অনেকেই তাকে শায়েস্তা খায়ের মেয়ে বলে জানেন।
বেশিরভাগ ঐতিহাসিকের ও ঢাকা বিশেষজ্ঞ "ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী" গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে চম্পা বিবি হলেন শায়েস্তা খানের 'উপপত্নী' বা পালিত কন্যা। তারা যুক্তি দিয়েছেন যে, যেহেতু চম্পা বিবি ছোট কাটরায় বাস করতেন এবং পরী বিবি শায়েস্তা খাঁর কন্যা তাই এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই যুক্তিটা গ্রহণ করা হয়, কারণ ছোট কাটরা নির্মিত হয় ১৬৬৪ সালে এবং সমাধিসৌধটির শিলালিপি দেখে জানা যায়, চম্পা বিবির সমাধিসৌধ নির্মাণ হয় ১৬৭১ সালে।
চার্লস ডয়েলী ১৮০৮ থেকে ১৮৪০ সাল পযন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে তিনি একেছিলেন বেশ কিছু স্কেচ।তার মধ্যে ১৮১৭ সালে চার্লস ডয়েলী ছোট কাটরার এই স্কেচটি করেছিলেন। ছবিতে ছোট কাটরা পাশে বিবি চম্পার সমাধি দেখা যা্চ্ছে।
মোগল শাসনামলে ঢাকা ছিল মোগলদের প্রাদেশিক রাজধানী। ১৭১৬ সালে মুঘল রাজধানী পরিবর্তনের পর থেকে ছোট কাটারা ও মুঘল ঢাকা এর গুরুত্ব হারাতে থাকে।
বর্তমানে ছোট কাটারা বা চম্পা বিবির সমাধিসৌধ বলতে এখন কিছুই বাকি নেই , শুধু ছোট কাটরার দু্ইপাশে ভাঙা ইমারত ছাড়া। যা শুধু বিশাল ফটকের মত সরু গলির উপর দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে অসংখ্য স্থাপনা এমন ভাবে নিমান করা হয়েছে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখানে মুঘল আমলের এমন একটি স্থাপত্য ছিল। এখানে পর্যটকরা তেমন একটা আসেন না; কারণ সমাধিসৌধটি এখন নেই এবং মাজার চত্বরটি দখল হয়ে গেছে। ছোট কাটরার প্রবেশের দুই পাশের দেয়াল ও প্রধান সড়কটি দখল হয়েছে এবং বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
ছোট ও বড় কাটারা ছাড়াও ঢাকায় আরও অনেকগুলি কাটারার নাম পাওয়া যায়, যেমন মুকিম কাটারা, বকশীবাজার কাটারা, মুঘলটুলি কাটারা, মায়া কাটারা, নওয়াব কাটারা, নাজির কাটারা, রহমতগঞ্জ কাটারা, মালদহের কাটারা, ক্যারাভান ও বাদামতলী কাটারা প্রভৃতি। কারওয়ান বাজারেও একগুচ্ছ কাটারা ছিল।
মুকিম কাটারা মহল্লাটির কিছু অংশ মৌলভী বাজার ও বাকিটা চকবাজারে অবস্থিত। এলাকাটিকে এখনও মুকিম কাটারা বলা হয়। এলাকাটি মির্জা মুকিমের নাম অনুসারে হয়েছিল। তিনি এ কাটারা ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দে মীরজুমলার শাসনকালে তৈরি করেন। এ কাটারার অস্তিত্ব এখন আর নেই।
এখন প্রায় বিলিন হতে চলেছে ঐতিহাসিক এই মোঘল স্থাপনা। ঝুকি মুখে রয়েছে এই মোঘল ইমারত। চার দিকে অংশক্ষ দোকান কারখানা সেই সাথে ছোট কাটারার চওরা দেয়ালের উপর গঠে ওঠেছে সুউচ্চ ভবন। গত কয়েক দশকে ধ্বংশ হয়েছে কাটারার বেশি ভাগ অংশ।ভবন নিমান কারী প্রতিষ্ঠান গুলোর চাপে মানচিএ থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে বসেছে এই ঐতিহাসিক মোঘল স্থাপনা।
তবে বড় কাটরা এবং ছোট কাটরা নামে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। তাই স্থাপনা না থাকলেও সড়কের নামের মাধ্যমে বেঁচে আছে মুঘল আমলের এই ঐতিহাসিক স্থাপনা দুটির নাম।
ছোট কাটরা কিভাবে যাবেন
ঢাকার গুলিস্থান থেকে আপনাকে প্রথমে যেত হবে সদর ঘাট লঞ্চ টামিনালে (ঘোড়ার গাড়িতে যেতে পাবেন), সেখান থেকে রিক্সা চেপে যেতে হবে সোয়রী ঘাট (ভাড়া ২০ টাকা) লেগুনা দিয়ে ও যেতে পারবেন, সোয়রী ঘাট থেকে অল্প একটু পথ হেটে গেলেই পরবে বড় কাটারা, বড় কাটারার খুব কাছে ই রয়েছে ছোট কাটারা (ছোট কাটারা আপনাকে খুজে বের করতে হবে, বা কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারন, ছোট কাটারা ধ্বংস হয়ে কেবল উত্তর আর দক্ষিনের ফটক এর কিছ অংশ টিকে আছে।)
আশেপাশের দর্শনীয় স্থান
ছোট কাটরার পাশেই বড় কাটরার অবস্থান। এছাড়া কাছাকাছি দূরত্বে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে- লালবাগ কেল্লা, তারা মসজিদ, শোয়ারী ঘাট, আর্মেনিয়ান চার্চ, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, আহসান মঞ্জিল সহ আরও অনেক স্থাপনা।