আসল হাজী-নান্নার বিরিয়ানি খেতে চলে আসুন পুরান ঢাকায়
পূর্ব বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছুই বহন করে পুরান ঢাকা। পুরান ঢাকার অলিতে গলিতে রয়েছে এর চিহ্ন। স্থাপত্য, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সঙ্গে খাবারেরও রয়েছে আলাদা সুনাম। পুরান ঢাকার খাবারের জনপ্রিয়তা ছাড়িয়ে গেছে দেশের গণ্ডিও।

পুরান ঢাকার পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী খাবারের বিশাল সম্ভার। বিরিয়ানি, কাবুলি, খিচুড়ি, হালিম, বাকরখানি, রুটি, কাবাব, শরবত, দোলমাজাতীয় তরকারিসহ নানা খাবার খেতে মানুষ এখনো যান পুরান ঢাকায়। রোজার মাসে ইফতারে তো ঢাকার মানুষের পছন্দের তালিকায় প্রথম সারিতে থাকে এসব খাবার।

শোনা যায় মোঘল আমাল থেকেই এসব খাবার জনপ্রিয়। আর অধিকাংশ খাবারই মোঘল। কালের বিবর্তনে তোররাবন্দি, শবডেগ, মোরগ মোসাল্লাম, খাগিনা, নার্গিস কোফতা, হারিরা, মাকুতি, মুতানজান, শিরমাল, গাওজাবান রুটি, গাওদিদা রুটি এমন খাবারের অনেকগুলো হারিয়ে গেছে। তবু কিছু টিকে রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে। টিকে থাকা সেসব জিভে জল আনা খাবার নিয়ে ভ্রমণকালের আজকের আয়োজন।

পুরান ঢাকার বিরিয়ানির স্বাদ আর ঐতিহ্যের সুনাম রয়েছে দেশজুড়ে। মোঘল আমল থেকেই পুরান ঢাকার বিরিয়ানি সবার কাছে খুব জনপ্রিয়। জানা যায়, মোঘলদের বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের প্রতি ছিল দুর্বলতা। আর বিরিয়ানি তাদের মধ্যে অন্যতম। আজও বিরিয়ানির সেই ঐতিহ্য পুরান ঢাকাবাসী ধরে রেখেছে। হাজীর বিরিয়ানি, নান্না মিয়ার বিরিয়ানি সেকথাই বলে।

হাজীর বিরিয়ানি

পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডে পা রেখে একটু সামনে এগোলেই দেখা মিলবে হাজীর বিরিয়ানির দোকান। ১৯৩৯ সালে হাজী মোহাম্মদ হোসেন এক হাঁড়ি বিরিয়ানি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে তার বিরিয়ানির স্বাদ ও খাবারের মান ভালো হওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে হাজীর বিরিয়ানির নামডাক।

কালক্রমে এই বিরিয়ানির ব্যবসার দায়িত্ব বুঝে নেন তার ছেলে হাজী গোলাম হোসেন। আর ব্যবসাটি বর্তমানে চালিয়ে যাচ্ছেন তার নাতি হাজী মোহাম্মদ সাহেদ হুসাইন। হাজীর বিরিয়ানির দোকানে বিক্রি হয় শুধু কাচ্চি বিরিয়ানি। এর বিশেষত্ব হলো- গরুর মাংসের পরিবর্তে শুধু খাসির মাংস এবং ঘি/বাটার অয়েলের পরিবর্তে সরিষার তেল ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সম্পূর্ণ দেশীয় সব মশলা ব্যবহার করা হয় বলে স্বাদে গন্ধে আজও সবার কাছে প্রিয় এই হাজীর বিরিয়ানি।

বর্তমানে হাজীর বিরিয়ানির হাফ প্লেটের দাম ৯০ টাকা। ফুল প্লেট ১৮০ টাকা। পুরান ঢাকা ছাড়াও হাজীর বিরিয়ানির দু’টি শাখা রয়েছে মতিঝিল বিমান অফিস ও বসুন্ধারা আবাসিক এলাকায়। সব বয়সী, সব শ্রেণীর মানুষই এখানে আসেন খেতে।

নান্নার বিরিয়ানি

১৯৬২ সালের দিকে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে বাবুর্চি নান্না মিয়া বিরিয়ানির দোকান দিয়ে আলোচনায় আসে। এখানে খাসির কাচ্চির পাশাপাশি মোরগ-পোলাও, খাসির বিরিয়ানি, খাসির রেজালা, ফিন্নি টিকিয়া ও বোরহানি পাওয়া যায়। প্রতি মাসের ৫ তারিখে আস্ত মুরগী সহ ১ বোল কাচ্চি বিরিয়ানি পাওয়া যায় মাত্র ৪০০ টাকায় । তবে মোরগ পোলাও, বোরহানি এবং লাবাং এর স্বাদ অতি সুস্বাদু। সেই সঙ্গে নান্না বিরিয়ানি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খাবার অর্ডার নিয়েও কাজ করে। যে কোন সামাজিক/অফিসিয়াল পার্টিতে খাবার সরবরাহের জন্য ক্যাটারিং সার্ভিস ব্যবস্থা রয়েছে।

বর্তমানে নান্না মিয়ার ছেলে হাজী মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এই ব্যবসাটি চালিয়ে আসছে। নান্না বিরিয়ানির মোট ৫টি শাখা রয়েছে। ৪টি শাখাই পুরনো ঢাকায় অবস্হিত। কিন্তু প্রথম এবং মূল দোকানটির সাথে এর শাখাগুলোর রান্নার কিছু পার্থক্য মনে হতে পারে। তাই এর ‘আসল’ স্বাদ নিতে চাইলে যেতে হবে পুরান ঢাকার বেচারাম দেউরীতে অবস্হিত মূল দোকানে। রেস্টুরেন্টটি সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ০৭.০০ টা থেকে রাত ১১.০০টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
আসল হাজী-নান্নার বিরিয়ানি খেতে চলে আসুন পুরান ঢাকায়
হাজীর বিরিয়ানি
এখানে মোরগ পোলাও ১১০ টাকা, খাসির বিরিয়ানি হাফ ১০০ আর ফুল ২০০ টাকা, খাসির কাচ্চি হাফ ১২০ টাকা এবং ফুল ২৪০ টাকা, বোরহানি ১/২ লিটার ১০০ টাকা ও লাবাং ১৪০ টাকা করে।

হাজী নান্না মিয়ার শাহী মোরগ পোলাও দোকানের পুরান ঢাকা ছাড়াও ৪টি শাখা রয়েছে। ৩৬/৩৭ লালবাগ চৌরাস্তায় একটি। ৮৮, নবাবগঞ্জ বাজারে ৩য় শাখা, ৪র্থ শাখাটি নাজিম উদ্দিন রোডে এবং অপরটি হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল আবাসিক (২য়তলা) টয়েনবি সার্কুলার রোড ফকিরাপুলে।

তবে এগুলো ছাড়াও পুরান ঢাকার উর্দু রোডের রয়েল বিরিয়ানি, নারিন্দার ঝুনার কাচ্চি বিরিয়ানি, মালিটোলার ভুলুর বিরিয়ানি, নবাবপুরের স্টার হোটেলের কাচ্চি বিরিয়ানি এবং নাজিমুদ্দন রোডের মামুন বিরিয়ানী দোকানের মতো অনেক বিরিয়ানির দোকানের মানও আপনাদের হতাশ করবে না।

কিভাবে যাবেন বিরিয়ানির খোঁজে

যদি আপনি পুরান ঢাকায় এসে হাজীর বিরিয়ানি খেতে চাইলে খুব সহজ হয় আপনি আজিমপুর এসে রিকশা নিয়ে বংশাল হয়ে কাজী আলাউদ্দিন রোডে চলে গেলে। এজন্য আপনার ৪০ থেকে ৫০ টাকা রিকশা ভাড়া গুনতে হবে। যদি রাস্তায় জ্যাম না থাকে তাহলে সময় লাগবে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। এছাড়া গুলিস্তান হয়েও যেতে পারেন। গুলিস্তান এলে পুরান ঢাকায় যাওয়ার অনেক বাস পেয়ে যাবেন। এতে আসা-যাওয়ায় ২০ থেকে ৩০ টাকায়।

আর নান্না মিয়ার বিরিয়ানি খেতে চাইলে সোজা আজিমপুর এসে রিকশা নিয়ে পুরান ঢাকার বেঁচারাম দেউড়ি চলে যাবেন। বেঁচারাম দেউড়ি নেমে হাতের বামে পেয়ে যাবেন নান্নামিয়ার শাহী মোরগ পোলাও অথবা বিরিয়ানির দোকান। রিকশাযোগে বেঁচারাম দেউড়ি যেতে ঠিক ৪০ থেকে ৫০ টাকা রিকশা ভাড়া গুনতে হবে। আরও একটি কথা জেনে রাখা ভালো। পুরান ঢাকার রাস্তা-ঘাট অনেকটা সরু হওয়ায় সেখানে নিজস্ব কোনো গাড়ি না নিয়ে গেলে ভালো হয়। কারণ ওই রাস্তাগুলোতে প্রাইভেট কার অথবা মোটরসাইকেল নিয়ে চলা দুষ্কর।

আরো দেখুন

হাজী ও নান্নার বিরিয়ানি খাওয়ার পাশাপাশি পুরান ঢাকরা বিখ্যাত কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখে আসতে পারেন। এর মধ্য- লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ, হোসেনী দালান, বিউটি বোডিং অন্যতম।