karamjal-sundarban
সুন্দরবনের আকর্ষণীয় যে কয়েকটি স্থান রয়েছে যেমন কটকা, কচিখালী, নীলকল, দুবলার চর, শেখের টেক মন্দির, মান্দারবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, হারবাড়িয়া, দোবেকী, কালিরচর, মৃগামারীম সুপতি ইত্যাদি সহ করমজল বিশেষ ভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। এদের মধ্যে করমজল পর্যটন কেন্দ্রে প্রতিবছর সুন্দরবনের অন্যান্য স্থানগুলোর চেয়ে সর্বাধিক সংখ্যক পর্যটক আসে। পশুর নদীর তীরে ৩০ হেক্টর আয়তনের আকর্ষণীয় এই পর্যটন কেন্দ্রটি সুন্দরবনের মডেল হিসাবে গড়ে তোলা হয়েছে। যারা একদিনে সুন্দরবন ঘুরতে চান তাদের জন্য করমজল পর্যটন কেন্দ্র একটি আদর্শ স্থান।

মংলা হতে করমজল লঞ্চ অথবা ট্রলারে চড়ে মাত্র ৪৫ মিনিটের পথ হওয়ায় দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসা যায় এবং ভ্রমনে তুলনামূলক খরচ কম হয়ে তাই অধিকাংশ পর্যটকেরই সুন্দরবন ভ্রমণে প্রথম পছন্দের জায়গা করমজল। পর্যটন কেন্দ্রটিতে লঞ্চ থেকে নেমে শুরুতেই বিশাল আকৃতির মানচিত্র দেখতে পাবেন, যা সুন্দরবন সম্পর্কে ধারণা দেবে। মানচিত্র পেছনে ফেলে বনের মধ্যে দক্ষিণে চলে গেছে আঁকাবাঁকা কাঠের তৈরি হাঁটা পথ। পথের নাম মাঙ্কি ট্রেইল।

এই নামের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় ট্রেইলে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই। পুরো ট্রেইল জুড়েই দেখা মিলবে সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা রেসাস বানরের। এই ট্রেইলের পুরোটা পথ জুড়েই রয়েছে বানরের আনাগোনা। রাস্তার দুই পাশে ঘন জঙ্গল। করমজলের এই এলাকায় বাইন গাছের সংখ্যা বেশি। কাঠের পথ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পর হাতের বাম দিকের শাখা পথ পশুর তীরে এসে থামেছে। শেষে মাথায়, আপনি নদীর তীরে একটি ছাউনি দেখতে পাবেন।

মূল পথটি আরও আধা কিলোমিটার দক্ষিণে গিয়ে একটি ছোট খালের পাড়ে এসে থামেছে। এখানে পথের মাথায় আরেকটি শেড আছে। সেখান থেকে কাঠের ট্রেইল আবার কুমিরের প্রজনন ক্ষেত্র পেরিয়ে পশ্চিমে চলে গেছে। এই ট্রেইলের মাঝামাঝি জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। এই ওয়াচ টাওয়ারে এর উপরে উঠলে করমজলের চারপাশটা ভালো করে দেখতে পাবেন।


কাঠের ট্রেইলের একেবারে শেষ প্রান্তে কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সেখান থেকে একটু পশ্চিমে হরিণ ও কুমিরের প্রজনন ক্ষেত্র। সামনে অনেক ছোট অনেকগুলো চৌবাচ্চা। কোনটিতে ডিম ফুটে বের হওয়া কুমির ছানা, কোনটিতে মাঝারি আকৃতির আবার কোনটিতে আরও একটু বড় বয়সের লোনা জলের কুমিরের বাচ্চা।

একেবারে দক্ষিণ পাশে দেয়াল ঘেরা বড় পুকুরে আছে রোমিও, জুলিয়েট আর পিলপিল। জেলেদের জালে ধরা পড়া এই তিন লোনা পানির কুমিরকে ২০০২ সালে সুন্দরবনের করমজলে আনা হয়। রোমিও-জুলিয়েটের বয়স এখন ২৩। এই জুটি প্রজননক্ষম হয় ২০০৫ সালে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম উপায়ে কুমির উৎপাদনে মূল অবদান তাদেরই। জুলিয়েট আকারে রোমিওর চেয়ে সামান্য ছোট। লোনা পানির এই প্রজাতির কুমির আশি থেকে একশো বছর বাঁচে।

জুলিয়েট এ পর্যন্ত ডিম দিয়েছে মোট ৪৮২টি। সেখান থেকে ২৮৪টি বাচ্চা ফুটিয়েছেন বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা। করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেক নারী সদস্য পিলপিল। এখন পর্যন্ত সে ডিম দিয়েছে ৪৪টি, যা থেকে বাচ্চা ফুটেছে ৩৩টি। এর পাশে, আপনি চিড়িয়াখানার মতো খাঁচায় ঘেরা একটি খোলা জায়গা দেখতে পাবেন। ভিতরে চিত্রা হরিণ। খাঁচার ভিতরে পশ্চিম কোণে আরেকটি ছোট খাঁচা আছে। ভিতরে কয়েকটি রেসাস বানর আছে।

পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো বিকেলে করমজল এলাকায় দল বেধে বন্য চিত্রা হরিণের আগমন এবং পর্যটকদের হাত থেকে খাবার গ্রহন। করমজল গিয়ে পর্যটকগন সহজেই সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ইকোসিষ্টেম সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারেন এবং সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ধিদ ও বন্য প্রাণীর সাথে পরিচিত হতে পারেন। পরিচিতির সুবিধার্থে এখানে বিদ্যমান গাছের সাথে নামফলক যুক্ত করে রাখা আছে।


প্রবেশ ফি/ টিকেট মূল্য

করমজলে দেশি পর্যটকের জন্য প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ২০ টাকা, বিদেশী পর্যটক ৩শ’ টাকা। ছাত্রদের জন্য টিকেট মূল্য ১০ টাকা। অপ্রাপ্ত বয়স্ক (বারো বছরের নিচে) দশ টাকা।

করমজল কিভাবে যাবেন

রাজধানী ঢাকার গাবতলী ও সয়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বাগেরহাটগামী বাস বা কমলাপুর ট্রেনে প্রথমে খুলনা পৌঁছাতে হবে। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে করে বাগেরহাট যাওয়া যায়।

ঢাকা থেকে বাগেরহাটে চলাচলকারী বাসগুলোর মধ্যে রয়েছে –
মেঘনা পরিবহন ( ০১৭১৭১৭৩৮৮৫৫৩ ), পর্যটক পরিবহন ( ০১৭১১১৩১০৭৮ ) যা সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়। এছাড়া ঢাকার গাবতলি বাস টার্মিনাল থেকে ছাড়ে – সাকুরা পরিবহন ( ০১৭১১০১০৪৫০ ), সোহাগ পরিবহন ( ০১৭১৮৬৭৯৩০২ ) ।

খুলনা থেকে রূপসা বা বাগেরহাটের মংলা বন্দর থেকে লঞ্চ পাবেন। এছাড়া বাগেরহাটের মংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা থেকে সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য নৌযান পাওয়া যায়।

ঢাকার সায়দাবাদ বাস স্টেশন থেকে সরাসরি মংলা যায় সুন্দরবন ও পর্যটক সার্ভিসের বাস। ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা। মংলা থেকে ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে যেতে হবে করমজল। দশ জনের উপযোগী একটি ইঞ্জিন নৌকার যাওয়া আসার ভাড়া ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা। এসব ইঞ্জিন নৌকাগুলো সাধারণত ছাড়ে মংলা ফেরি ঘাট থেকে।


করমজল যেতে হয় পশুর নদী পাড়ি দিয়ে। এই নদী সবসময়ই কম-বেশি উত্তাল থাকে। তাই ভালো মানের ইঞ্জিন নৌকা নিয়ে যাওয়া উচিৎ। আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন নৌকায় পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট আছে কী না।

কোথায় থাকবেন

ট্যুরিস্ট ভেসেল বা নৌযান ছাড়াও সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে হিরণপয়েন্টের নীলকমল এবং টাইগার পয়েন্টের কচিখালী ও কাটকায় বন বিভাগের রেস্টহাউজে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। যার ফি নীলকমলে দেশি পর্যটকদের জন্য প্রতি কক্ষ তিন হাজার টাকা,চার কক্ষ ১২ হাজার টাকা। কচিখালী প্রতি কক্ষ তিন হাজার টাকা, চার কক্ষ ১০ হাজার টাকা। কটকা প্রতি কক্ষ দুই হাজার টাকা, দুই কক্ষ চার হাজার টাকা। বিদেশিদের ক্ষেত্রে নীলকমলে পাঁচ হাজার ও ২০ হাজার টাকা, কচিখালীতে পাঁচ হাজার ও ১৫ হাজার টাকা এবং কাটকায় পাঁচ হাজার ও ১০ হাজার টাকা।

এছাড়া সারাদিন করমজলে বেড়িয়ে রাতে এসে থাকতে পারেন বন্দর শহর মংলায়। এখানে আছে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের মোটেল পশুর (০৪৬৬২-৭৫১০০)। নন এসি ডবল রুমের ভাড়া ১ হাজার ২শ’ টাকা এবং এসি ডবল রুম ২ হাজার টাকা। ইকনোমি বেড ৬শ’ টাকা। এছাড়াও মংলা শহরে সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে। এসব হোটেলে ১শ’ থেকে ৬শ’ টাকায় কক্ষ পাওয়া যাবে।

অথবা সুন্দরবনের পাশে সাতক্ষীরা শহরে হোটেল পাবেন সাধারণ মানের ও শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জে এনজিও সুশীলনের রেস্টহাউস ও ডরমেটরিতে একা,পরিবার ও গ্রুপ নিয়ে থাকার সুবিধা রয়েছে।

খুলনা মহানগরে ক্যাসেল সালাম, হোটেল রয়েল, হোটেল ওয়েস্ট ইন্, হোটেল টাইগার গার্ডেন, হোটেল সিটি ইন, হোটেল মিলিনিয়াম ইত্যাদি মানসম্পন্ন হোটেল ছাড়াও সাধারণ মানের হোটেল রয়েছে।

ভ্রমণকালে পরামর্শ

⦿ বনরক্ষী ছাড়া জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবেন না।
⦿ হরিণ ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের কোন প্রাণীকে খাবার দিবেন না।
⦿ বনের ভিতর জোড়ে শব্দ করবেন না।

আরো দেখুন