টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যা দেখবেন, যাবার উপায় | ভ্রমণকাল

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যা দেখবেন, যাবার উপায়

টাংগুয়ার হাওর,টাংগুয়ার হাওর ভ্রমণ,টাংগুয়ার হাওর ছবি,টাংগুয়ার হাওর কোথায় অবস্থিত,টাংগুয়ার হাওর নৌকা,টাংগুয়ার হাওর ভ্রমন গাইড
চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা টাঙ্গুয়ার হাওরসুনামগঞ্জ জেলার ১০০কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এই টাঙ্গুয়ার হাওর। ভারতের মেঘালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই হাওর। মূলত মেঘালয় পর্বত থেকে প্রায় ৩০টি ঝর্ণা এসে মিশেছে এই টাঙ্গুয়ার হাওরের পানিতে। আজকে এই আটিকেলে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যা দেখবেন, এবং হাওরে যাবার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো।

টাঙ্গুয়ার হাওর এটি দেশের ২য় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হিসেবে পরিচিত। অথৈ পানির গভীর জলাভূমি, ঘাঢ় নীল আকাশ, পাহাড়ের শুভ্রতা ও চোখ জুড়ানো সবুজে ঘেরা এই হাওরটি অপরূপ রূপে সজ্জিত। এর মোট আয়তন ৬৯১২ একর।


টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে যা দেখবেন

বর্ষাকালে এই হাওরের আয়তন আরও অনেক বেড়ে যায়। এই হাওরকে বলা হয় বাংলাদেশের ২য় রামসার অঞ্চল! রামসার কনভেনশন হলো বিশ্বব্যাপী জৈব পরিবেশ রক্ষার একটি সম্মিলিত প্রয়াস। এখানে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির সরীসৃপ জীবের বৈচিত্র্যের সমাহার দেখা মিলে। আশেপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে এই হাওরে শীতকালে নাম না জানা প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখি আশ্রয় নেয়।

টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ভারতের মেঘালয় পাহাড়গুলো একদম স্পষ্ট দেখা যায়। এই হাওরে ২টি অনেক বড় ওয়াচ টাওয়ার আছে। হাওরের পানিগুলো অনেক বেশি স্বচ্ছ হওয়ার ফলে উপর থেকে হাওরের তলা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। মোট ১২০টি বিল ও ১৮০টি নিম্নাঞ্চল মিলে এই হাওরের সৃষ্টি। তাই এই হাওরকে স্থানীয়রা নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল বলে থাকে। এখানে ছোট ছোট ভাসমান প্রায় ৪৬টি দ্বীপ বা গ্রাম আছে।


টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

টাঙ্গুযার হাওরে বর্ষাকালে যাওয়াটাই সবচেয়ে উত্তম। কেননা অন্যান্য সময় এখানে পানি অনেক কম থাকে। বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টিতে পানি পরিপূর্ন থাকে। বর্ষায় বিশাল হাওরে সাগরের মতো ঢেউ দেয়। হাওরে বর্ষায় এক রূপ, আবার শীতে অন্যরূপ ধারণ করে।

আর যদি পানির সৌন্দর্য দেখতে চান তাহলে অবশ্যই শীত মৌসুমে যাওয়া ভালো। শীতকালে এর রূপ বদলাতে থাকে। বিশেষ করে অধিকাংশ পর্যটনরা শীতকালে ঘুরতে আসে এই টাংগুয়ার হাওরে। এখানে আনাগোনা করে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা! সেই মেঘ কখনও জমাট, আবার কখনও হালকা বাতাসে দোলা দেয়। হাওরের দুপাশেই কিনারাহীন জলাভূমি। প্রবেশ মুখেই দেখা যায় সারিসারি হিজলগাছ।

যেনো মনে হয় গাছগুলো হাওরে আগত অতিথিদেরকে অভিবাদন জানাচ্ছে। আর মূল হাওরে প্রবেশ করলে দেখা যায় পানির নিচের নানা প্রজাতির লতাপাতা জাতিয় জলজ উদ্ভিদ।

শীতের শুরু থেকে শেষ অব্দি পাখিদের মিলন মেলা চোখে পড়ার মতো। তবে সবচেয়ে বেশি পাখি দেখা যায় ফেব্রুয়ারি মাসে। পানকৌড়ি, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, গাংচিল, বক, সায়স, কাক, শংখচিল ইত্যাদি নাম অজানা নানা প্রজাতির পাখি এসে ভিড় জমায় এখানে।

পাখিদের কলকাকলীর শব্দে সদা মুখরিত থাকে এই হাওরটি। এখানে ছোট ছোট সোয়াম্প, ফরেস্ট, ভূ-স্বর্গ, বারিক্কা টিলা, বিশাল বাগান, বর্ডার, যাদুকাটা নদী, লাউয়ের গড় ইত্যাদি আরও অদেখা অনেক কিছু দেখার জন্য পর্যটনদের উপচে পড়া ভিড় সারা বছর লেগে থাকে। খুব কাছ থেকে এখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য মিলে।

বিশাল এই জলাভূমিতে প্রকৃতি বেড়ে ওঠে তার আপন গতিতে। অতিথি পাখিগুলো শীতের সকালের সোনালি রোদে সূর্যস্নান সেরে দল বেঁধে চড়ে বেড়ায়।

টাঙ্গুয়ার হাওর নৌকা ভাড়া

নৌকা ভাড়া করতে কিছু বিষয় খেয়াল রাখুন যেমন নৌকায় বাথরুম আছে কিনা, সোলার প্যানেলের মাধ্যমে মোবাইল চার্জ দেয়া যায় কিনা, লাইট ও ফ্যানের ব্যবস্থা ব্যবস্থা আছে কিনা। নৌকা ভাড়া করার সময় দরদাম করে নিন।

নৌকা ভাড়া মূলত ৩টি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। নৌকায় ধারণ ক্ষমতা, নৌকার সুযোগ সুবিধা এবং সিজনের উপর। সাধারণত ছোট নৌকা ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা, মাঝারি নৌকা ২৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকা এবং বড় নৌকা সারদিনের জন্য ভাড়া নিবে ৩৫০০ থেকে ৬০০০ টাকা।

১ রাত নৌকায় কাটাতে চাইলে ছোট নৌকা ৩৫০০-৫০০০ টাকা এবং বড় নৌকা ভাড়া করতে ৭০০০ থেকে ১০,০০০ টাকার মত লাগবে। নৌকায় সোলার প্যানেল ও লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা না থাকলে তাহিরপুর বাজার থেকে আইপিএস ও লাইফ জ্যাকেট ভাড়া নিতে পারবেন। রান্নার জন্য নৌকার মাঝিকে খরচের টাকা দিলে সে বাবুর্চি নিয়ে যাবে কিংবা নিজেই রান্নার ব্যবস্থা করে ফেলবে। কি করবেন তা অবশ্যই মাঝির সাথে আগে আলোচনা করে দরদাম ঠিক করে নিবেন।

টাঙ্গুয়ার হাওর যাবার উপায়/কিভাবে যেতে হয়

ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ
ঢাকা থেকে সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে মামুন, শ্যামলি পরিবহন বাসে করে সরাসরি সুনামগঞ্জ চলে আসতে পারেন। ভাড়া নিবে নন এসি বাসে মাত্র ৬৫০-৭৫০ টাকা। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘন্টা সময় লাগে। সুনামগঞ্জ এসে সেখানে নেমে অরমা নদীর উপর বড় ব্রিজের কাছে লেগুনা অথবা সিএনজি করে চলে আসবেন তাহিরপুর। তাহিরপুর থেকে নৌকাঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে ঘুরে আসুন টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে। তো আর দেরি না করে এখনই বেড়িয়ে পরুন টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশ্যে।

সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ
সিলেটের কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ যাবার লোকাল ও সিটিং বাস আছে। সিটিং বাস ভাড়া ১০০ টাকা, সুনামগঞ্জ যেতে দুই ঘন্টার মত সময় লাগবে। অথবা শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে লাইট গাড়ি তে ২০০ টাকা ভাড়ায় সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়।

সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়ার
সুনামগঞ্জ নেমে সুরমা নদীর উপর নির্মিত বড় ব্রীজের কাছে লেগুনা/সিএনজি/বাইক করে তাহিরপুরে সহজেই যাওয়া যায়। তাহিরপুরে নৌকা ঘাট থেকে সাইজ এবং সামর্থ অনুযায়ী নৌকা ভাড়া করে বেড়িয়ে আসুন টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে। তবে শীতকালে পানি কমে যায় বলে আপনাকে লেগুনা/সিএনজি/বাইক যোগে যেতে হবে সোলেমানপুর। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে নিতে পারবেন। আর শীতকালে গেলে আপনি অতিথি পাখির দেখা পাবেন।

খাবার ব্যবস্থা

দিনে দিনে ঘুরে চলে আসলে তাহিরপুরে খাবার হোটেল থেকে রওনা হবার আগে সকালের ও ফিরে আসার পর দুপুরের খাবার হাওরের প্রায় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে নিজের পছন্দের মাছ দিয়ে আহার পর্ব সেরে ফেলতে পারেন। আর যদি টাঙ্গুয়ায় রাতে থাকার পরিকল্পনা থাকে এবং নিজেরা রান্না করে খাওয়ার ইচ্ছে থাকে তবে তাহিরপুর থেকে নৌকায় উঠার আগে যে কয়দিন অবস্থান করবেন সেই কয়দিনের বাজার করে নিতে পারেন। আর তাজা মাছ কেনার জন্য হাওরের মাঝখানের ছোট বাজারগুলোতে যেতে পারেন। এছাড়া সাথে নিতে পারেন দেশি হাঁস কিংবা দারুণ সব শুঁটকি। আবার নিজেরা রান্না করার ঝামেলা এড়াতে চাইলে টেকেরঘাট রাত্রি যাপন করলে সেখানে টেকেরঘাট বাজার থেকে রাতের খাবার খেয়ে নিতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন

টাঙ্গুয়ার হাওরে থাকার জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। তবে যদি নৌকায় রাত কাটাতে চান তবে নিরাপত্তার জন্যে পাড়ের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করুন। আর ঘর ভাড়া করতে চাইলে টেকেরঘাট এলাকায় হাওর বিলাশ নামে কাঠের বাড়িতে সল্প মূল্যে রুম ভাড়া নিয়ে থাকতে পারবেন। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরে নৌকায় এক রাত থাকার অভিজ্ঞতা নিলে অবশ্যই ভাল লাগবে।

টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণকালে সতর্কতা ও পরামর্শ

  • হাওরে ভ্রমণকালে অবশ্যই আপনার সাথে লাইফ জ্যাকেট নিবেন।
  • হাওরে এলাকায় কোন কিছু কেনার সময় দামাদামি করে নিবেন।
  • কয়েকজন একসাথে গ্রুপ করে ভ্রমণ করলে আপনার খরচ কম পরবে। আপনি ছোট গ্রুপ যেমন ৪-৫ জন বা ৮-১০ জনের গ্রুপ করে যেতে পারেন।
  • হাওর এলাকা যে কোন সময় বৃষ্টি অথবা বজ্রপাত হতে পারে, বজ্রপাত হলে নৌকার ছৈয়ের নিচে অবস্থান নিবেন।
  • দুপুরে বা রাতে খাবার সময় অতিরিক্ত অংশ/উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট ইত্যাদি হাওরের পানিতে ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
  • উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী মাইক বা সাউন্ট বক্স বাজানো থেকে বিরত থাকুন।

টাঙ্গুয়ার হাওর এর কাছাকাছি আরো কিছু দর্শনীয় স্থান

⦿ যাদুকাটা নদী
⦿ বারিক্কা টিলা
⦿ শিমুল বাগান
⦿ নিলাদ্রী লেক

আরো দেখুন

দৃষ্টি আকর্ষণ: আমাদের পর্যটন স্পট গুলো আমাদের দেশের পরিচয় বহন করে এবং এইসব পর্যটন স্পট গুলো আমাদের দেশের সম্পদ। এইসব স্থানের প্রাকৃতিক কিংবা সৌন্দর্য্যের জন্যে ক্ষতিকর এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন। আর ভ্রমনে গেলে কোথাও ময়লা ফেলবেন না। দেশ আমাদের, দেশের সকল কিছুর প্রতি যত্নবান হবার দায়িত্বও আমাদের।
ভ্রমণকাল: আমাদের টিম সবসময় চেষ্টা করে আপনাদের কাছে হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করতে। যদি কোন তথ্যগত ভুল কিংবা বানান ভুল হয়ে থাকে বা ভ্রমণ স্থান সম্পর্কে আপনার কোন পরামর্শ থাকে অথবা আপনার কোন ভ্রমণ গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান তাহলে Comments করে জানান অথবা আমাদের কে ''আপনার মতামত'' পেজ থেকে মেইল করুন।