sea-travel-story
আমি ফাহমিদা খানম লিমা, ২০১৬ ইং সাল, আমার প্রথম সমুদ্র দর্শন, আমার জীবনের অন্যতম স্মৃতিময় বছর। সেই বছরের ফেব্রুয়ারী মাসের ২৪ তারিখে ছেলের স্কুলের পিকনিক ছিল। ১৫ তারিখের দিকে ছেলের বাবাকে স্কুলের পিকনিকের কথা জানালে, সে বলল এখনই পিকনিক কনফার্ম করো না। কারন জিজ্ঞেস করায় বলল, অফিসে তার ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার কারনে, কক্সবাজারের একটা ট্রিপ ২ বছর আগেই পেয়েছিল, কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে তা আর এভেইল করতে পারেনি। এখন সে সেই ট্রিপটা এভেইলের চেষ্টা করছে, অফিস এলাউ করলে পরের সপ্তাহেই আমাদেরকে নিয়ে সেন্টমার্টিন বেড়াতে যাবে।

এই কথা শুনে আমার তো আর আনন্দ ধরে না। বরাবরই ঘুরার খুব শখ ছিল আমার, বাবা ছিল ঢাকার একটা মসজিদের ইমাম আর আমি ছিলাম মাদ্রাসার ছাত্রী, তাই ইচ্ছে করলেও ঢাকার আশেপাশে ছাড়া দূরে কোথাও ঘুরার সুযোগ হয়ে উঠেনি। আর বিয়ের পরও কিছুটা আর্থিক আর কিছুটা পারিবারিক কারনে গ্রামের বাড়ি ছাড়া ঢাকার বাহিরে আর কোথাও যাওয়া হয়ে উঠেনি। তাছাড়া অনেক আগে থেকেই মনের ভিতর সমুদ্রে যাবার প্রবল একটা ইচ্ছে ছিল।

২০০৯ ইং সালে আমার বিয়ে হয়েছে, এরপর ২০১০ সালের মার্চ মাসের ৬ তারিখ আমার বর অফিস থেকে একটা প্লেজার ট্যুরে কলিগদের সাথে সেন্টমার্টিন এবং কক্সবাজার গিয়েছিল। সেসময় একদিন মাঝরাতে ও আমাকে ফোন দিয়ে কক্সবাজারের সমুদ্রের গর্জন শুনিয়েছিল। এরপর থেকে আমি প্রায়ই অবচেতন মনে সমুদ্রের গর্জন শুনতাম আর মনে মনে ভাবতাম, কবে যাব আমি সমুদ্রের কাছে? কবে এই গর্জন শুনব নিজ কানে? কবে হাটবো আমি বালুর মধ্যে খালি পায়ে?

অবশেষে ফেব্রুয়ারীর ১৭ তারিখের দিকে আমার বর আমাকে জানালো আমরা পরের সপ্তাহেই প্রথমে সেন্টমার্টিন যাব তারপর কক্সবাজার হয়ে ঢাকা ফিরব, আর আমাদের সাথে ওর এক কলিগের পরিবারও যাবে।

এরপর শুরু হয়ে গেল আমাদের টেনশন, কারন আমার মেয়ের বয়স মাত্র ২ বছর ১ মাস আর ছেলের ৪ বছর ৯ মাস। এত ছোট দুইটা বাচ্চা নিয়ে লম্বা একটা বাস জার্নি করতে হবে, আর দুরের বাস জার্নির কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা আমাদের ছিল না। এই রকম এক টেনশন নিয়েই আমার বর ২২ তারিখ সন্ধ্যার টেকনাফের টিকেট কেটে ফেলল, কিন্তু জাহাজের টিকেট কিংবা হোটেল কোনটাই বুকিং দিতে পারল না। ২১ তারিখ দিবাগত রাত আমার একফোটাও ঘুম এলো না। একেতো সমুদ্রের উত্তাল আহবান আর অন্যদিকে ছোট দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে পারব কিনা, এই টেনশন।


সেন্টমার্টিন/দারুচিনি দ্বীপের উদ্দেশে রওনা হলাম

আমার বাসা খিলক্ষেত, আর বাস আরামবাগ থেকে সন্ধ্যা ৬ টায়। বর দুপুরের পরই অফিস থেকে চলে এল। ঢাকার রাস্তার ট্রাফিক জ্যামের কথা মাথায় রেখে মহান আল্লাহ্‌র নামে দুপুর ৩ টায় আমরা রওনা দেই বাস কাউন্টারের উদ্দেশ্যে। সেদিন প্রচন্ড গরম ছিল। বাস ছাড়ার কিছুক্ষণ পরই আমার মেয়ে তার বাবার কোলে বমি করে দিল, পানি দিয়ে কোন ভাবে সেটা পরিষ্কার করলাম। টেনশন আরো বেড়ে গেল, কিন্তু আল্লাহ্‌র অশেষ রহমতে আর কোন সমস্যা ছাড়াই আমরা খুব সকালেই টেকনাফ জাহাজ ঘাটে পৌছে যাই। আমরা সেখানেই একটা হোটেলে নাস্তা করি। কিছু সময় পর আমার বরের কলিগ তার ফ্যামিলি নিয়ে ঘাটে পৌছাল, আমরা পরিচিত হলাম। কেয়ারী সিন্দবাদে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য কোন টিকেট পেলাম না। পরে কুতুবদিয়ার ঘাটে গেলাম, সেখানে মাস্টার ব্রীজের টিকেট পেলাম, মানে জাহাজের মাষ্টার/সারেং এর রুমের পাশের বারান্দায় আমাদের বসতে দিল। আমরা পূর্ব দিকের বারান্দায় বসলাম। অনেক রোদ ছিল, গরমে কষ্ট পাচ্ছিলাম কিন্তু সমুদ্র দেখার উত্তেজনায় আর নাফ নদীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে সেই কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম।

সেন্টমার্টিন/দারুচিনি দ্বীপের উদ্দেশে জাহাজ ছাড়ল

সাড়ে নয়টার দিকে দারুচিনি দ্বীপের উদ্দেশ্যে জাহাজ ছাড়ল। আমার বাড়ী চাঁদপুর, ছোট বেলা থেকেই লঞ্চেই যাতায়াত করি তাই সত্যি বলতে কি, এই জাহাজ দেখে আমার মাঝে নতুন কোন ফিলিংসই কাজ করেনি। কিন্তু তখনও বুঝি নাই আল্লাহ্‌র কি অপরূপ সৃষ্টি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। এত এত গাঙচিল দেখে আর ওদের খাবার খাওয়া দেখে বারংবার মনে হচ্ছিল, আল্লাহ্‌ প্রত্যেকটা প্রাণীর রিজিকই কত উত্তম ভাবেই না রেখেছেন। গাঙচিলের সাথে সাথে আগ পিছে চলতে চলতে ঘণ্টা খানেক কেটে গেল,
আমার ছেলেমেয়ে গাঙচিলের সাথে খেলতে পেরে খুবই মজা পেল, সারারাতের জার্নির কষ্ট পুরোপুরি ভুলে গেল।


একটা সময় নাফ নদী চিড়ে জাহাজ সাগরের বুকে গিয়ে পড়ল, আর আমি দেখলাম জীবনের প্রথম সমুদ্র। দেখলাম সীমানাহীন নীল পানি। সাগর অনেকটাই শান্ত ছিল, খুব বেশী ঢেউ ছিল না, তবুও জাহাজটি একবার উপরে উঠছিল আবার নামছিল। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর স্বপ্নের দারুচিনি দ্বীপটা আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হতে লাগল। আমারতো আর তর সইছিল না, মনটা কেবলই ছটপট করছিল কখন নামবো সাগরের পানিতে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সমুদ্র যাত্রার পর জাহাজ গিয়ে ভিড়ল দারুচিনি দ্বীপের জেটিতে, আমরা নামলাম স্বপ্নের দারুচিনি দ্বীপে। কিন্তু দ্বীপে গিয়ে দেখলাম ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা, আসলে কাকতালীয় সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা।

তাই দ্বীপে পর্যটকদের ভিড় ছিল অনেক বেশি। আগে থেকে বুকিং দিতে না পারায় পছন্দসই হোটেল/রিসোর্ট পেলাম না। শেষ পর্যন্ত বাজারের কাছেই ব্লু-ওশানে উঠলাম। হালকা ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে লাঞ্চ করলাম পাশের ব্লু-মেরিনে সামুদ্রিক কোরাল আর রূপচাঁদা ভাজি দিয়ে, জীবনে প্রথম কোরাল মাছ খেলাম, অসাধারণ ছিল সেই স্বাদ। তারপর ছুটলাম সমুদ্রের টানে।
sea-travel-story
সমুদ্রের পানিতে প্রথম ভিজলাম, প্রথম সমুদ্র স্নান। সেই অনুভুতি ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার ছেলেমেয়েও বাধ ভাঙ্গা আনন্দে মেতে উঠল। তারা বালু দিয়ে বাড়ী তৈরী করছিল আর ঢেউ এসে সেগুলো ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তারা খুব মজা পাচ্ছিল। বিশেষ করে ঢেউ এসে যখন আমার ছেলে-মেয়ের মাথার উপর দিয়ে চলে যেত তখন ওরা খুবই মজা পেত। আমার ছোট পরীটাও খুব মজা পাচ্ছিল, মাশাআল্লাহ। আমি এবং আমার ছেলেমেয়ে ছোট ছোট শামুক ঝিনুক কুড়ালাম।


প্রায় দেড় ঘণ্টা সমুদ্রের পানিতে ঝাপাঝাপি করে আমি মেয়েকে নিয়ে রুমে চলে আসলাম, যদিও উঠতে মোটেও মন চায়নি তবুও ছোট মেয়ের ঠান্ডার কথা চিন্তা করে নিজের অবাধ্য মনকে শান্ত করি। তখনও ছেলে আর ছেলের বাবা পানিতে ছিল, তারা আরোও ২ ঘণ্টা পানিতে ছিল।
sea-travel-story

বিকেল বেলায় সমুদ্র পাড়ে

বিকেলে আমরা সমুদ্র পাড়ে হাঁটতে বের হলাম। সমুদ্র তট দিয়ে খালি পায়ে হাটছিলাম আর হালকা পা ভিজাচ্ছিলাম, যা ছিল আমার অনেক দিনের স্বপ্ন, আর অনুভুতি, সেটা লিখে বুঝানো যাবে না। সেদিন মনে হল, সময়ের অনেক আগেই সূর্যটা অস্ত গিয়েছে, কুয়াশার আবরনে ঢেকে গিয়েছে। সন্ধ্যার পরও অনেকক্ষণ সমুদ্রের পাড়ে বসে ছিলাম।
sea-travel-story
পাড়ে বসে ডাব খেলাম। হালকা বাতাস আর সমুদ্রের বিরামহীন ছোট ছোট ঢেউ, এক অন্য রকম অনুভুতি।


রাতে একটা হোটেলে মাছের বার-বি-কিউ অর্ডার করলাম। তারপর বাজারে কিছুটা হাটাহাটি করলাম, অল্পকিছু কেনাকাটা করলাম। তারপর গেলাম জেটির কাছে। ভরা পূর্ণিমার জোসনায় সমুদ্রের নীল জল তখন অন্যরকম এক মোহনীয় রূপ ধারন করেছিল। আমরা কিছুক্ষণ জেটিতে বসে জ্যোৎস্না স্নান করলাম। রাতের খাবার খেয়ে আমরা আবার জেটিতে আসব, এই ভেবে রাতের খাবার খেতে হোটেলে চলে আসলাম।

বার-বি-কিউ দিয়ে রাতের খাবার মাত্র শুরু করলাম, এমন সময় আমার বর বলল, ওর খুব খারাপ লাগছে, বুকে একটা প্রেশার অনুভব করছে আর প্রচুর ঘামছে, ও আর খাবে না, বলল রুমে চলে যাবে। খাওয়া ফেলে ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি রুমে চলে আসলাম। রুমে এসে সে শুয়ে পড়ল। রুমে এসেও ও খুব ঘামছিল। ওকে নিয়ে খুব টেনশনে পড়ে গেলাম। এদিকে কোন ডাক্তারও নেই, আমি কি করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। দেখলাম শহরের বাহিরে আসলেই আমরা কতটা অসহায়। ওকে নিয়ে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। শেষ ভরসা, কেবল আল্লাহ্‌ আল্লাহ্‌ করতে লাগলাম আর বিভিন্ন দোয়া পড়ে ওকে ফুঁ দিতে লাগলাম। অন্যদিকে আমার ছেলের শরীরের তাপমাত্রাও বাড়তে লাগল, সাথে শরীরে কিছু র‍্যাশ দেখা গেল।

আমারতো মাথায় হাত কারন আমাদের এখান থেকে কক্সবাজার যাওয়ার কথা, সে অনুসারেই হোটেল আর বাসের টিকেট কাটা হয়ে গেছে। মানে আমাদের আরো দুইদিন পর ঢাকায় যাওয়ার কথা। আল্লাহ্‌র কাছে শুধু দোয়া করতে লাগলাম, আল্লাহ্‌ যেন সব কিছু ভাল করেন। ছেলেকে জ্বরের ঔষধ খাওয়ালাম। কোন রকমে অনেকটাই নির্ঘুম রাত পাড় করলাম।

দারুচিনি দ্বীপে ২য় দিন

পরেরদিন অনেক ভোরে উঠলাম। আলহামদুল্লিলাহ, আমার বর অনেকটাই সুস্থ্য হয়ে উঠল। আর ছেলের শরীরে হালকা জ্বর থাকলেও র‍্যাশ আর বাড়েনি, ভাবলাম হয়তো অ্যালার্জি জনিত কোন সমস্যা হবে। ঘুম থেকে উঠেই খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলাম জেটির কাছে। সেখান থেকে সূর্যউদয় দেখলাম, জেলেদের মাছ ধরে আনার দৃশ্য দেখলাম। খুব ভাল লাগল, ছেলেমেয়েও বিভিন্ন রকমের মাছ দেখে খুব মজা পেল। তারপর জেটির কাছেই নাস্তা করে আমরা পাড় দিয়ে হেটে হেটে চলে গেলাম পশ্চিম তীরে।


দেখলাম হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সমুদ্র বিলাস বাংলো। আমার কাছে পশ্চিম পাড়ের এই জায়গাকে সেন্টমার্টিনের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা মনে হয়েছে। কি নীরব কিন্তু এক অসাধারণ মুগ্ধতা নিয়ে ভালোবাসার আবেশে আমাকে ভরিয়ে দিয়েছে। সকালে ছেড়াদ্বীপে যাওয়ার কথা থাকলেও ছেলের এবং তার বাবার শরীরের অবস্থা চিন্তা করে তা বাদ দিয়েছিলাম, সেই সাথে আবার সমুদ্রে ভেজার চিন্তাও বাদ দিয়েছিলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা পশ্চিম তীরে কাটিয়ে মন ভরে ডাবের পানি খেয়ে আমরা হোটেল রুমে চলে আসলাম। হালকা ফ্রেশ হয়ে আগে ভাগেই দুপুরের খাবার খেয়ে আবার সমুদ্র পাড়ে চলে গেলাম
sea-travel-story
এবং সেখানে থাকলাম ফিরতি জাহাজ ছাড়ার আগ পর্যন্ত।

কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলাম

দারুচিনি দ্বীপকে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরতি জাহাজে উঠে তিন তলায় চলে গেলাম আমাদের নির্ধারিত স্থানে। এবার আমাদের সিট হল পশ্চিম পাশে। প্রথমে সূর্যের তেজ অনেকটা বেশী থাকলেও আস্ত আস্তে তা কমতে লাগল আর পশ্চিম আকাশ নীল বর্ণ থেকে লাল বর্ণ ধারন করতে লাগল। একটা সময় পুরো পশ্চিম আকাশ লাল রক্তিম আভায় ভরে গেল। অনিন্দ্য সুন্দর ছিল সেই দৃশ্য। ধীরে ধীরে সূর্যটা টেকনাফের পাহাড়ের খাঁজে হারিয়ে গেল, আর আমি দেখলাম আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর এক সূর্যাস্ত।


দারুচিনি দ্বীপের ভালোবাসার এক অন্যরকম আবেশ নিয়ে রাত সাড়ে নয়টার দিকে এসে পৌছালাম কক্সবাজারে। সরাসরি চলে গেলাম আগে থেকেই ঠিক করে রাখা হোটেল মিডিয়ায়, যেটি ঠিক লাবনি পয়েন্টে অবস্থিত আর এটি থেকে বীচ খুবই কাছে। হালকা ফ্রেস হয়ে নামাজ পড়ে পোউসীতে গেলাম রাতের খাবার খেতে। সে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা, ১৫ রকমের ভর্তার একটা ডিস নিলাম। খুবই টেষ্টি ছিল প্রায় প্রতিটি ভর্তা। দুই ফ্যামিলির চার জন মিলেও সেই ভর্তা খেয়ে শেষ করতে পারলাম না।

রাতের খাবার শেষ করেই চলে গেলাম সমুদ্রের কাছে। খুব কাছ থেকে শুনলাম, অনেক দিন ধরে অবচেতন মনে শুনা মোহনীয় সেই গর্জন। সমুদ্রের গর্জন আমাকে পাগল করে তুলেছিল। পা টা সামান্য ভিজালাম। মনটা ভরে গেল, মনে হল সারা রাত যদি সমুদ্রের পাড়ে কাটিয়ে দিয়ে পারতাম। কিন্তু কিছুক্ষণ সেখানে থেকে রুমে চলে আসতে হল কারন ছেলের শরীরের অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপ হচ্ছিল। ছেলের জ্বর ধীরে ধীরে বাড়ছিল সাথে সাথে র‍্যাশের সংখ্যাও বাড়ছিল। ওকে জ্বরের ঔষধ খাওয়ালাম। পরদিন সকালে হোটেলের বারান্দা থেকে এবং নাস্তা করার সময় জানালা দিয়ে অবারিত নীল সমুদ্র দেখলাম। একদিকে বৃষ্টি হচ্ছিল আর অন্যদিকে ছেলের জ্বর তাই তখন ইচ্ছে করলেও সাগরের কাছে যেতে পারছিলাম না।


ঔষধ খাওয়ানোর পর ছেলের জ্বর কিছুটা কমল, এদিকে বৃষ্টিও থেমে গেল। তখন আবার গেলাম সাগর পাড়ে। কিন্তু ছেলের শরীরের অবস্থা চিন্তা করে আর পানিতে নামলাম না, কারন আমরা নামলে সেও নামতে চাইবে। আর কোন রিস্ক নিতে চাচ্ছিলাম না। এত সাধনার পর কক্সবাজারের সমুদ্রের কাছে আসা, এত কাছে সমুদ্র কিন্ত ভিজতে পারছিলাম না, এটা অনেক কষ্টের। এই আপসোস হয়তো আমার আজীবনই রয়ে যাবে।

তারপর আমরা একটা সিএনজি অটোরিক্সা ভাড়া করে প্রথমে রামু ঘুরে ইনানী এলাম, তারপর হিমছড়ি গেলাম। আমরা টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকে সিড়ি বেয়ে হিমছড়ি পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। আমার বর আগে বেশ কয়েকবার কক্সবাজার গেলেও হিমছড়ি কখনোই ঢুকেনি। তাই পাহাড়ের উচ্চতা সম্পর্কে আমাদের কোন আইডিয়াই ছিল না। এটা তে উঠতে আমাদের খুবই কষ্ট হয়ে গেল কারন আমার অ্যাজমার সমস্যা, আমার ছেলের গায়ে ১০৪ ডিগ্রী জ্বর, আর আমার মেয়ে তার বাবার কোলে, আবার রেলিংও অনেক জায়গায় ভাঙ্গা। এ এক ভয়ংকর অবস্থা। উপরে উঠতে উঠতে সূর্য ডুবে গেল। তাই পাহাড়ের উপর থেকে সাগরের সৌন্দর্য পরিপূর্ণ ভাবে আর দেখতে পেলাম না।

তারপরও যতটুকু দেখেছি, আলহামদুল্লিলাহ। সেখান থেকে নামার সময় ছেলে আমাকে বলল, আম্মু আমি আর পারছি না, আমাকে কোলে নেও। আমি তখন তাকে বললাম, বাবা আমি যদি তোমাকে কোলে নেই তাহলে তুমি এবং আমি কেউই নামতে পারব না। তুমি আম্মুকে ধরে ধরে আস্তে আস্তে নামতে থাক, ইনশাআল্লাহ্‌ আমরা নামতে পারব। আমার লক্ষী সোনাটা আমার কথা শুনে এত কষ্টের মাঝেও আমাকে ধরে ধরে আস্তে আস্তে নেমে এলো।


এদিকে তার র‍্যাশের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল, মুখেও কয়েকটা উঠল, আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হলাম তার চিকেন পক্স হয়েছে। রাতের গাড়িতে আমরা ঢাকা চলে এলাম। বাসায় ফিরেই তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার নিশ্চিত করল তার চিকেন পক্স হয়েছে, সেই সাথে আসার পর মেয়েরও চিকেন পক্স শুরু হয়েছে।

আমার প্রথম সমুদ্র দেখা অনেক কারনেই আমার কাছে সারা জীবনের জন্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেখান থেকে ফেরার পর আমার মেয়ে টিভিতে বা সামনাসামনি যেখানেই পানি দেখত, কেবলই বলত সে আবার কক্সবাজার যাবে, যদিও তখন সে ঠিকমত কক্সবাজার উচ্চারনও করতে পারত না। ওর এই বিরামহীন আবদারের কাছে মাথা নত করে আমার বর মাত্র ছয় মাসের মাথায় ঐ বছরেরই সেপ্টেম্বরে আমাদের নিয়ে আবারও তিনদিনের জন্যে কক্সবাজার গিয়েছিল। সেবার আমরা মনভরে ভিজেছি, গোসল করেছি, টানা ৪/৫ ঘণ্টা ধরেও সমুদ্রের পানিতে ছিলাম। এই ট্যুরে ভোর থেকে শুরু করে রাত অবধি প্রায় সর্বক্ষণ (খাওয়া এবং রাতের ঘুম ছাড়া) আমরা সমুদ্র তীরে কাটিয়েছিলাম।

আসলে এখন ছেলে-মেয়ের আনন্দই আমাদের আনন্দ, ওদের কথাই সবার আগে প্রধান্য দিতে হয়।
sea-travel-story
তারপরও সমুদ্র আমাকে সবসময়ই টানে, বিশেষ করে সেন্টমারটিনের নীরবতা আর মায়াবী সৌন্দর্য কখনোই ভুলতে পারিনি। কিন্তু অনেকবার উদ্দ্যেগ নিয়েও শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। ইনশাআল্লাহ্‌ খুব শিগগিরই আমরা আবার সেখানে যাব।


এই দেশটা আমাদের সকলের। আসুন দেশটাকে সুন্দর, পরিষ্কার রাখতে নিজে থেকেই স্বচেষ্ট হই, অন্যকেও স্বচেষ্ট করি। আর আমরা বদলে গেলেই, বদলে যাবে আমাদের দেশ। অনেক দীর্ঘ এই লেখাটা কষ্ট করে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

এই ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন:
ফাহমিদা খানম লিমা
গৃহিনী, ঢাকা থেকে