বগালেক | ভ্রমণকাল

বগালেক

বগালেক, বান্দারবান
বগালেক বা বগাকাইন হ্রদ বান্দরবানের বুকে মহান সৃষ্টিকর্তার এক অনন্য নিদর্শন। প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট এ হ্রদ সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ২৭০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচ্চতার স্বাদু পানির হ্রদ এটি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এই লীলাভূমি বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে কেওক্রাডং পর্বতের গা ঘেঁষে রুমা উপজেলায় অবস্থিত। রুমা উপজেলা থেকে বগালেকের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলো মিটার। ফানেল বা চোঙা আকৃতির আরেকটি ছোট পাহাড়ের চূড়ায় বগা লেকের অদ্ভুত গঠন অনেকটা আগ্নেয় গিরির জ্বালা মুখের মতো। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গণের মধ্যে বগালেক প্রায় ২ হাজার বছর আগে মৃত আগ্নেয় গিরির জ্বালামুখ কিংবা মহাশূন্য থেকে উল্কাপিন্ডের পতনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে।

তবে বগালেক-কে ঘিরে রয়েছে অনেক মিথ। একে অনেকে ড্রাগন লেকও বলে। শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যেতে পারে বগালেক প্রকৃতির এক অনন্য নিদর্শন। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আসার ক্লান্তি হারিয়ে যায় হ্রদের অতল গহ্বরে। ক্ষণে ক্ষণে যেন এর রুপ বদলায়। তাই প্রতিটা ভিন্ন সময়ে বগালেক-কে দেখতে পাওয়া যায় ভিন্ন রূপে। রাতে চাঁদের মৃদু আলোর ঝলকে লেকের পানিতে যেন আকাশের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। বগালেকে বম আদিবাসীদের কে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বগালেক পাড়া। আদিবাসীদের সাথে মিশে যাওয়া এক অনন্য পরিবেশ এটা। বগালেকের পাশাপাশি পাহাড়ি রাস্তার আঁকাবাঁকা পথ পর্যটকদের এখানে আকৃষ্ট করে।

কখন যাবেন বগালেক

বর্ষাকালে রুমাগামী জীপ কইক্ষ্যংঝিড়ি পর্যন্ত যায়। তারপর ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে প্রায় ১ ঘন্টার অধিক পথ পাড়ি দিয়ে রুমা সদরে যেতে হয়। রুমা থেকে পায়ে হেটে অথবা জীপে করে বগালেক যেতে হয়। বর্ষা মৌসুমে বগা লেক যাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। তাই বগালেক ভ্রমণে শীতকাল কে বেছে নেওয়া ভালো হবে। বলা চলে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বগালেক ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।

বগালেক কিভাবে যাবেন

বাংলাদেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন বগালেকে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে বান্দরবানে আসতে হবে। এসি এবং ননএসি এই দুই ধরনের বাস এ রুটে যাতায়াত করে। ঢাকা থেকে এস আলম, শ্যামলী, হানিফ, সেন্টমার্টিন পরিবহন, সৌদিয়া, ইউনিক, ডলফিন ইত্যাদি পরিবহনের বাস বান্দরবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া নন-এসি ৫৫০ টাকা ও এসি ৯৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। ঢাকা থেকে বান্দরবানে বাসে যেতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ ঘন্টা।

আর ট্রেনে যেতে হলে ঢাকা থেকে সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, তুর্ণা নিশিতা, মহানগর গোধুলী এসব ট্রেনে করে চট্টগ্রামে যেতে পারবেন এবং চট্টগ্রাম থেকে বাসে অথবা প্রাইভেট কারে করে বান্দরবানে যেতে পারবেন। শ্রেণীভেদে ট্রেনের ভাড়া ৩৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম থেকে পূরবী ও পূর্বাণী এই দুই ধরনের বাস বান্দরবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ৩০ মিনিট এবং ভাড়া ৭০ টাকা জনপ্রতি। এছাড়াও আকাশপথে সরাসরি চট্টগ্রামে আসতে পারবেন।

বান্দরবান থেকে বগালেক: বান্দরবান শহর থেকে বগালেক যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে রুমাবাজার। বান্দরবান থেকে রুমা বাজারের দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। চাঁদের গাড়ি কিংবা বাস দিয়ে রুমা বাজারে যাওয়া যায়। একসাথে ১০ থেকে ১৫ জন করে গেলে চাঁদের গাড়ীতে করে যেতে পারবেন। ভাড়া ২০০০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর একা থাকলে কোন একটা টিমের সাথে যুক্ত হয়ে যেতে পারবেন।

বাসে যেতে হলে বান্দরবানের রুমা বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে। বান্দরবান থেকে এক ঘন্টা পর পর বাস রুমার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ভাড়া ১২০ টাকা সময় লাগবে ৩ ঘন্টা। তবে চাঁদের গাড়ীতে করে গেলে সময় লাগে ২ ঘন্টা। রুমা বাজার থেকে বগালেক যেতে হলে প্রথমে একজন পর্যটন গাইড নিতে হবে এবং এটা বাধ্যতামূলক। প্রতিদিনের জন্য গাইড কে তার ব্যক্তিগত খরচ বাদে দিতে হবে বিজিবি দ্বারা নির্ধারিত ৬০০ টাকা। রুমা বাজারে আর্মি ক্যাম্পে বগালেক যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে হবে। অনুমতিপত্রে নিজের পরিচয় দিয়ে ফরম পূরণ করতে হয়। অবশ্য গাইড আপনাকে এ কাজে সাহায্য করবে।

বিকাল ৪ টার পর বগালেকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না। রুমা বাজার হতে বগালেকের দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। রুমা বাজার থেকে জিপ অথবা চাঁদের গাড়ি করে বগালেকে যেতে হয়। ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা করে। বগালেক পৌঁছে লেকের পাড়ে বিজিবি ক্যাম্পে পুনরায় নাম ঠিকানা এন্ট্রি করতে হবে।

কিভাবে কম খরচে বগালেকে যাবেন

বান্দরবান শহর থেকে বাসে রুমা বাজারে যেতে পারবেন সেক্ষেত্রে ভাড়া ১২০ টাকা জনপ্রতি। রুমা বাজার থেকে লোকাল চাঁদের গাড়ীতে করে বগালেক যেতে পারবেন এক্ষেত্রে ভাড়া ১০০ টাকা জনপ্রতি।

বগালেক কোথায় থাকবেন

বগালেক কে কেন্দ্র করে উন্নত মানের কোন হোটেল বা রিসোর্ট গড়ে ওঠেনি। তবে আদিবাসীদের ছোট ছোট কিছু কটেজ আছে। কটেজ গুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে আদিবাসীদের দ্বারা গড়ে উঠেছে। কটেজের ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা। একটি কটেজ বাড়িতে ১২ থেকে ১৪ জন থাকা যায়। এছাড়াও কাপড় কিংবা মহিলাদের জন্য আলাদা কটেজের ব্যবস্থা করা যায়, এজন্য গাইডের সহযোগিতা নিতে পারেন। গাইড কে দিয়ে কটেজ আগে থেকেই ঠিক করা যায় আবার গিয়েও ঠিক করা যায়।

কিভাবে কম খরচে বগালেকে থাকবেন

কম খরচে থাকতে চাইলে গাইডকে আগে থেকেই বলতে হবে এবং লেক থেকে দূরের কটেজগুলোর ভাড়া কিছুটা কমে পাওয়া যায়।

কিভাবে বিলাসবহুল ভাবে বগালেকে থাকবেন

বগালেকে উন্নত মানের কোন রেস্ট হাউজ নেই। এখানে কাপলদের জন্য আলাদা কটেজ আছে। তাতে ভাড়া কিছুটা বেশি। এছাড়া পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের একটি অত্যাধুনিক রেস্টহাউস নির্মাণাধীন রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে সেখানে রাত্রি যাপন করার সুযোগ ঘটবে পর্যটকদের। এছাড়া সিয়াম দিদির হোটেলে (ফোন ০১৮৪০৭২১৫৯০) থাকতে পারেন।

বগালেকে কোথায় খাবেন

রুমা বাজারে পৌঁছে সেখানে খাবার খেয়ে নিতে পারেন। প্রায় সব ধরনের খাবারের হোটেল সেখানে আছে। বগালেকে আদিবাসীদের পাড়াতেও খাবার হোটেল আছে। গাইড কে বলে খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবেন। আদিবাসীদের ঘরের সামনে চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা আছে। সেখানে রাতের খাবার খেতে পারবেন। সাধারণত ১০০ থেকে ২০০ টাকার খাবারের প্যাকেজ পাওয়া যায়। ভাত, ডিম, আলু ভর্তা, পাহাড়ি মুরগি দিয়েই হয় খাবারের আয়োজন।

ভ্রমণকালে পরামর্শ

বগালেকে বিদ্যুৎ নেই, তাই সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যেতে পারেন মোবাইল চার্জ দেওয়ার জন্য। তবে সেখানে সোলার পাওয়ার এর ব্যবস্থা আছে। সাথে জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি রাখুন। বগালেকে যাবার জন্য অবশ্যই আর্মি ক্যাম্পে অনুমতি নিতে হবে। বগালেকে কোন মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না তবে রবি ও টেলিটকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় তাই সাথে যে কোন একটা সিম রাখুন। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় সব সময় সতর্ক থাকুন। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র সাথে রাখুন যেমন- খাবার স্যালাইন, ট্র্যাকিং জুতা, হাল্কা ওষুধ, বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবার।

সম্প্রতি গোসল করতে গিয়ে কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে তাই গোসল করার সময় সতর্ক থাকুন। আদিবাসীদের অনুমতি ছাড়া ছবি তুলবেন না। আদিবাসীদের অসম্মান হয় এমন কাজ করবেন না। প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ করবেন না।

আশেপাশে দেখার কি আছে

হাতে সময় থাকলে বগালেকের আশে পাশে আরো কিছু স্পট ঘুরে দেখতে পারেন। এরমধ্যে অন্যতম কেওক্রাডং। বগালেক থেকে কেওক্রাডং যেতে চাইলে ১ দিন বাড়তি সময় লাগবে। কেওক্রাডংয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে। যাওয়ার পথে দেখতে পারবেন চিংড়ি ঝর্ণা। এছাড়া বান্দরবানের অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে নীলগিরি। এটি সর্বাধিক জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। এছাড়া থানচিতে আছে নাফাখুম জলপ্রপাত এবং রোয়াংছড়িতে আছে দেবতাখুম নামে একটি গিরিখাদ উল্লেখযোগ্য।

আরো দেখুন

বাংলাদেশের অন্যান্য লেক - 〉 মহামায়া লেক, 〉 ফয়েজ লেক, 〉 মাধবপুর লেক, 〉 কাপ্তাই লেক
দৃষ্টি আকর্ষণ: আমাদের পর্যটন স্পট গুলো আমাদের দেশের পরিচয় বহন করে এবং এইসব পর্যটন স্পট গুলো আমাদের দেশের সম্পদ। এইসব স্থানের প্রাকৃতিক কিংবা সৌন্দর্য্যের জন্যে ক্ষতিকর এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন। আর ভ্রমনে গেলে কোথাও ময়লা ফেলবেন না। দেশ আমাদের, দেশের সকল কিছুর প্রতি যত্নবান হবার দায়িত্বও আমাদের।
ভ্রমণকাল : আমাদের টিম সবসময় চেষ্টা করে আপনাদের কাছে হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করতে। যদি কোন তথ্যগত ভুল কিংবা বানান ভুল হয়ে থাকে বা ভ্রমণ স্থান সম্পর্কে আপনার কোন পরামর্শ থাকে অথবা আপনার কোন ভ্রমণ গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান তাহলে Comments করে জানান অথবা আমাদের কে ''আপনার মতামত'' পেজ থেকে মেইল করুন।