ময়নামতি জাদুঘর | ভ্রমণকাল

ময়নামতি জাদুঘর

ময়নামতি জাদুঘর
ময়নামতি বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা শহরে অদূরের একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্ব স্থান। কুমিল্লা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি অবস্থিত। ময়নামতি হলো লালমাই অঞ্চলে অবস্থিত সবচেয়ে প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন। বর্তমানে এ অঞ্চলে যে ধ্বংসস্তুপ দেখা যায় তা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রাচীন নগরী জয়কর্মান্তবসাক ও বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ।

মধ্যযুগের বৌদ্ধ রাজত্বের রাজধানী ছিল এটি। ধারণা করা হয় রাজা মানিক চন্দ্রের স্ত্রী রাণী ময়নামতির নামানু সারে অনুচ্চ এই পাহাড়ী এলাকার নাম রাখা হয় ময়নামতি। এক সময় এটি লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। পরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বহু জায়গা দৃশ্যমান হয়। কুমিল্লা জেলার অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এখানেই রয়েছে। এখানকার শালবন বিহার ও আনন্দ বিহার প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।

প্রাচীন জনপদের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে লালমাই পাহাড়, শালবনবিহার, আনন্দ বিহার, কুটিলা মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, রূপবান মুড়া, চন্ডী মন্দির সহ ৫৪ টি ডিবি ও বৌদ্ধ বিহার। এখানকার আবিষ্কৃত প্রত্নসম্পদ ষষ্ঠ শতাব্দীর হতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রাচীন বঙ্গ, সমতটের স্মৃতি বহন করে। আশির দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অনুসন্ধান চালিয়ে ৫০ টি সংস্কৃতির ঢিবির মধ্যে ২৩টি কে প্রত্নতাত্ত্বিক পুরাকীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করে। এই পুরাকীর্তিগুলো সবসময়ই জ্ঞানপিপাসুদের কাছে আকর্ষিত হয়।

ময়নামতিতে শালবন বিহার সবচেয়ে জনপ্রিয়। এর আসল নাম ভবদেব মহাবিহার। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহারের মতো দেখতে তবে আকারে ছোট এই প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি শালবন রাজার বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন সময়ে এ এলাকা খননকার্য চালিয়ে বিভিন্ন তথ্য ও পুরাকীর্তি সংগ্রহ করা হয়। অসাধারণ নির্মাণশৈলী এবং অভূতপূর্ব পরিকল্পনায় গড়া শালবনবিহারের প্রতিটি দেয়াল কুঠুরি। শালবন বিহারের প্রতিটি বাহু ৫৫০ ফুট দীর্ঘ। এখানে সর্বমোট ১৫৫ টি কক্ষ রয়েছে। চার বাহুতে সর্বমোট ১১৫ টি সন্ন্যাস কক্ষ, মধ্যভাগে একটি উন্নত মন্দির ও উত্তর বাহুর মধ্যবর্তী স্থানে বিশালাকার তোরণ রয়েছে।

শালবনবিহারের দক্ষিণ পাশে শালবন কে সামনে রেখে পশ্চিমমুখী একটি জাদুঘর রয়েছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে ময়নামতি জাদুঘর। ময়নামতি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান থেকে প্রাপ্ত অনেক মূল্যবান সামগ্রী সংগ্রহ করা হয় এই জাদুঘরে। পুরো জাদুঘর ভবনে মোট ৪২ টি আধার রয়েছে। যাতে সকল পুরাসামগ্রী প্রদর্শিত হয়। বিভিন্ন ধাতু লিপি ফলক, প্রাচীন মুদ্রা, ধ্বংসাবশেষ ভূমি-নকশা, পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জ মূর্তি, পাথরের মূর্তি, লোহার পেরেক, অলংকারের অংশ, হাড়ি পাতিল ইত্যাদি জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়। প্রতিবছর দেশী বিদেশী অনেক পর্যটক এখানে আসে ইতিহাসকে স্বচক্ষে অবলোকন করতে।

ময়নামতি জাদুঘর টিকিট মূল্য

শালবন বিহার ও জাদুঘরের গেটের পাশেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার। প্রতিটি টিকেটের দাম জনপ্রতি ২০ টাকা। তবে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য টিকেটের দরকার হয় না। শিক্ষার্থীদের জন্য টিকেটের মূল্য ৫ টাকা, বিদেশীদের জন্য ২০০ টাকা, সার্কভুক্ত বিদেশীদের জন্য ১০০ টাকা।

সময়সূচী

জাদুঘর সকাল ১০ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালে ৯ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত। দুপুরে আধা ঘণ্টা (১:০০-১:৩০) বিরতি থাকে। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া রবিবার সাধারণত বন্ধ থাকে এবং সোমবার বেলা ২ টা থেকে খোলা থাকে।

ময়নামতি জাদুঘর কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে কুমিল্লা শহরের দূরত্ব ১০১ কিলোমিটার। এসি ও নন-এসি দুই ধরনের বাস চলাচল করে। বিআরটিসি, তিশা সার্ভিস, এশিয়া লাইন, প্রিন্স সার্ভিস, প্রাইম সার্ভিস, কর্ডোভা সার্ভিস, রয়েল কোচ ইত্যাদি পরিবহনের বাস কুমিল্লার উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট। ভাড়া ২২০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।

আবার চট্টগ্রামগামী অনেক ট্রেনে করে কুমিল্লাতে যাওয়া যায়। মহানগর প্রভাতি, মহানগর এক্সপ্রেস, চট্টগ্রাম মেইল, কর্ণফুলী এক্সপ্রেস প্রভৃতি ট্রেনে করে কুমিল্লা যাওয়া যায়। ভাড়া ৯০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। কুমিল্লা শহরের যেকোনো স্থান থেকে সিএনজি রিজার্ভ করে ময়নামতিতে যেতে পারবেন। এছাড়াও সরাসরি সিএনজি প্রাইভেট কারে ঢাকা থেকে কুমিল্লার ময়নামতিতে যেতে পারবেন।

কিভাবে কম খরচে যাবেন

ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে নন-এসি বাস গুলোতে করে কুমিল্লা যেতে পারেন। ভাড়া টাকা থেকে ৩৫০ টাকা। কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে নেমে কোটবাড়ি যাওয়ার লোকাল সিএনজি রয়েছে। সেখান থেকে কোটবাড়ি যেতে হবে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০ টাকা। কোটবাড়ি থেকে অটোরিকশায় ময়নামতিতে যেতে পারবেন। রিকশায় ভাড়া ১০ টাকা।

কোথায় থাকবেন

কুমিল্লা শহরে অনেক হোটেল রয়েছে রাত্রি যাপন করার জন্য ৩০০ টাকার রুম থেকে শুরু করে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট পাবেন।

কিভাবে কম খরচে থাকবেন

কুমিল্লা শহরের হোটেল চন্দ্রিমা, হোটেল শালবন, হোটেল আবেদীন, হোটেল সোনালী, হোটেল নিদ্রাবাগ, আশিক রেস্ট হাউস, হোটেল নুরজাহান ইত্যাদি হোটেলগুলোতে ২০০ থেকে ৬০০ টাকায় থাকতে পারবেন।

কোথায় খাবেন

কুমিল্লা শহরে অনেক খাবারের হোটেল পাবেন। এ সকল হোটেলে সব ধরনের খাবার পাবেন। ডায়না হোটেল, ইদ্রিস মিয়ার খাবার হোটেল, আল আরাফাত হোটেল, হোটেল বিসমিল্লাহ, জান্নাত হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট, হোটেল ভাই ভাই, মাজার হোটেল, খাজা হোটেল, ইন্দ্রজিৎ ঘোষ কেবিন হোটেল,জাহানারা হোটেল, শাহজালাল হোটেল, শুকরিয়া প্রভৃতি হোটেলে ভালো মানের খাবার পরিবেশন করে থাকে। সংগীতশিল্পী আসিফ আকবরের বাংলা রেস্তোরাঁ ,কুমিল্লার খাবার আর খাবারের পরিবেশে নতুন মাত্রা আনে। রসমালাই এর জন্য কুমিল্লা বিখ্যাত তাই এটা খেতে ভুলবেন না কখনো।

ভ্রমণকালে পরামর্শ

যেকোনো দেশের প্রত্নসম্পদ তার দেশের ঐতিহ্য বহন করে সুতরাং এ সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনে তারপর যাবেন। প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের ক্ষতি হয় এমন কোন কাজ করবেন না। কোনো বিশৃঙ্খলা জড়াবেন না। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না। খাবার স্যালাইন ও পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সাথে রাখবেন। বাস ভাড়া, হোটেলে থাকার ক্ষেত্রে দরদাম করে নেবেন। কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই খেতে ভুলবেন না। জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ নাম্বারে এ কল করুন।

কুমিল্লার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান

কুমিল্লার অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি, শালবন বিহার, ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক, বার্ড, ডাইনো পার্ক, রাজেশপুর ইকো পার্ক, শালবন বৌদ্ধ বিহার ও ধর্মসাগর দীঘি উল্লেখযোগ্য।
দৃষ্টি আকর্ষণ: আমাদের পর্যটন স্পট গুলো আমাদের দেশের পরিচয় বহন করে এবং এইসব পর্যটন স্পট গুলো আমাদের দেশের সম্পদ। এইসব স্থানের প্রাকৃতিক কিংবা সৌন্দর্য্যের জন্যে ক্ষতিকর এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন। আর ভ্রমনে গেলে কোথাও ময়লা ফেলবেন না। দেশ আমাদের, দেশের সকল কিছুর প্রতি যত্নবান হবার দায়িত্বও আমাদের।
ভ্রমণকাল: আমাদের টিম সবসময় চেষ্টা করে আপনাদের কাছে হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করতে। যদি কোন তথ্যগত ভুল কিংবা বানান ভুল হয়ে থাকে বা ভ্রমণ স্থান সম্পর্কে আপনার কোন পরামর্শ থাকে অথবা আপনার কোন ভ্রমণ গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান তাহলে Comments করে জানান অথবা আমাদের কে ''আপনার মতামত'' পেজ থেকে মেইল করুন।