সেন্টমার্টিন অভিযান | ভ্রমণকাল

সেন্টমার্টিন অভিযান

saint-martin-travel-history
সবার জীবনেই এমন একটা সময় আসে যখন গতানুগতিক নাগরিক ব্যাস্ততার ভীরে জীবনটা হাপিঁয়ে ওঠে। তখন মনটা একটু ট্যুর ট্যুর করে। আমাদের আজকের গল্পটাও তেমনই একটি ঐতিহাসিক ট্যুরের। গল্পটা শুরু হয়েছিলো ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে।

কোম্পানির সারা বছরের ক্লোজিং রিপোর্ট জমা দেয়া শেষ। একটু রিফ্রেশমেন্টে যেনো জরুরি হয়ে পড়েছিলো। এমন সময়ে ঘোষণা আসে অফিসের সবাইকে নিয়ে ট্যুরে যাওয়া হবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। যে সময়টাতে একটু ভ্রমণের জন্য মনটা আনচান করছিলো। এমন একটা সময়ে কোম্পানি থেকে ট্যুরের ঘোষণা পেতেই যেনো সবাই আনন্দে নেচে উঠলো।

বিশেষ করে আমি, আতাউর, হাসান আর ফয়সাল একটু বেশিই এক্সাইটেড ছিলাম।কারণ অফিসের মধ্যে আমাদের চার জনকে সবাই ভ্রমণ পাগল হিসেবে জানে। প্রতি বছর ছুটি পেলেই আমরা কোথাও না কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসি। দীর্ঘ দিন ধরেই চার বন্ধু মিলে প্লান করছিলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপে গিয়ে কোনো একটা পূর্ণিমা রাত কাটাবো। কিন্তু বিধি বাম। কোনা ভাবেই টাইমিং মিলছিলো না। ভরা পুর্ণিমা তিথিতে অফিস থেকে ছুটি পাইনা। আবার যখন ছুটি পাই তখন পুর্ণিমা তিথি পড়ে না। কিন্তু এবার যেনো বিধি মুখ তুলে তাকালেন। ভরা পুর্ণিমা তিথিতেই অফিস থেকে ট্যুরের ঘোষণা পেলাম তাও আবার আমাদের স্বপ্নের গন্তব্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে

২৬ তারিখ রাত ৯টায় অফিস থেকে বাস ছাড়বে। প্লান হয়েছে প্রথমে আমরা কক্সবাজার যাবো সেখানে সারাদিন ঘুরাঘুরি করে একটা হোটেলে এক রাত থেকে পরের দিন ভোরে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো এবং টেকনাফ থেকে শিপে করে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে চলে যাবো আমাদের স্বপ্নের গন্তব্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে।

২৬ তারিখ, রাত ৯টা
আমাদের রিপোর্টিং টাইম ছিলো রাত ৮:৩০ মিনিট। সবাই ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে যথারীতি অফিসের নিচে হাজির হলাম। অফিস থেকে আমাদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে নাইট কোচের একটি ডিল্যাক্স বাস। সবাই জাস্ট টাইমে হাজির হলাম। কিন্তু হাসান এখনো আসেনি। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের গ্রুপে হাসানের একটা দুর্নাম আছে। সে কখনো টাইমলি কোথাও আসতে পারে না। সবাই তাকে লেট লতিফ বলে খেপায়। অফিসে প্রতিদিন লেট করে আসার কারণে বসের কাছে কতো ঝাড়ি যে খেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এদিকে হাসানকে বাদ দিয়ে বাসও ছাড়া যাচ্ছে না। বস তো রেগে মেগে আগুন। উনার সাফ কথা জাস্ট নয়টায় বাস ছাড়বে। হাসান যদি সময় মতো আসতে না পারে তাহলে ওর ট্যুর মিস।

ফয়সাল গেলো বসকে কনভেন্স করতে। কারণ হাসান না গেলে ট্যুরটাই মাটি হয়ে যাবে। আমাদের গ্রুপে হাসানের গানের গলা সবচেয়ে ভালো। ভালো একজন শিল্পী না থাকলে কি ট্যুর জমে? তাছাড়া জোসনা রাতে সাগর পাড়ে বসে হাসানের কণ্ঠে গান না শুনলে ট্যুরটা যেনো অপূর্ণই রয়ে যাবে।

ফয়সাল কোনো মতে বসকে বুঝিয়ে কিছু সময় নিলেন হাসানের জন্য। আসলে ফয়সালের কনভেন্স করার ক্ষমতাটা অসাধারণ! সে যে কাউকে যে কোনো বিষয়ে কনভেন্স করে ফেলতে পারে।

৯:১০ মিনিটে হন্তদন্ত হয়ে হাসান এসে হাজির। এসেই দাঁত কপাটি বের করে একটা হাসি দিয়ে বললো পথে রিক্সার টায়ার পান্চার হয়ে গিয়েছিলে তাই আসতে একটু দেরি হয়ে গেলো। যাই হোক অবশেষে আমাদের বাস ছাড়লো। বাসে যাওয়ার সময় গান বাজনা আর হৈ হুল্লরে ট্যুরের প্রকৃত আমেজটাই যেনো সবাই অনুভব করছিলাম। গান গাইতে গাইতে কখন যে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই।

২৭ তারিখ ভোর ৫টা, কক্সবাজার
ভোর ৫টা বাজে আমাদের বাস কক্সবাজার এসে থামলো। আগে থেকেই হোটেল বুকিং করা ছিলো। যথারীতি যে যার রুমে এসে ব্যাগ পত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। সবাইকে সকালের নাস্তার জন্য রেস্টুরেন্টে ডাকা হলো। পরোটা, সবজি এবং ডিম ভাজি দিয়ে আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর প্লান হলো আমরা বিচে গিয়ে ফুটবল খেলবো এবং সমুদ্র স্নান করবো।

যেই ভাবা সেই কাজ। নাস্তা শেষে দল বেধে সবাই কলাতলি বিচে চলে গেলাম। এই প্রথম আমার সমুদ্র দেখা। বাকিরা অবশ্য এর আগে কক্সবাজারে এসেছিলো।

এখানে আসার আগে সমুদ্র নিয়ে যেই নস্ট্যালজিয়া কাজ করছিলো আসার পর সেই অনুভুতিটা যেনো কর্পূরের মতো উবে গেলো। সবসময় নীল সমুদ্রের স্বপ্ন দেখেছি, এখানে এসে দেখলাম সমুদ্রের বিচিত্র রুপ। কোথায় নীল? এখানে তো সব ঘোলা পানি। আমরা বাঙ্গালীরা আসলে আমাদের প্রকৃতির সঠিক সংরক্ষণ করতে শিখিনি।

ভারত মহাসাগরের একটি উপসাগর হলো এই বঙ্গপসাগর। আর কক্সবাজার হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ সমুদ্র সৈকত। অথচ সমুদ্রে ঘুরতে এসে সমুদ্রকে নোংরা বানিয়ে ফেলেছি আমরা। চারপাশে পড়ে আছে আবর্জনা, চিপসে আর বিস্কুটের প্যাকেট আরো কতো কি! এসব দেখে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু মন খারাপ তো করা যাবে না। ঘুরতে এসেছি ঘুরাঘুরিটা উপভোগ করতে হবে।

সমুদ্র তীরে বালিতে শুরু হলো আমাদের ফুটবল খেলা। সবাই দুটো দলে বিভক্ত হয়ে খেলা শুরু করলাম। প্রায় ঘন্টা দেড়েক খেলার পর সবাই ক্লান্ত হয়ে নেমে পড়লাম সমুদ্র স্নানে। পানি যদিও ঘোলা ছিলো কিন্তু সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ গুলো আমাদের মনে দোলা দিচ্ছিলো।

এখানে আরো ঘন্টা দুয়েক কাটালাম। সমুদ্রের পানিতে চোখ জ্বালা শুরু করেছিলো। তাই সবাই চলে গেলাম হোটেল রুমে। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে দুপুরের খাবার খেতে বের হলাম। সামুদ্রিক মাছ সহ হরেক রকমের আইটেম দিয়ে লাঞ্চ সেরে হোটেল রুমে ফিরে এলাম।

ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নিলাম ক্লান্তি দূর করতে কারণ বাসে কারোই ভালো ঘুম হয়নি। ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে আমরা চার বন্ধু বের হয়ে পড়লাম আবারো সমুদ্রের তীরে। এবার উদ্দেশ্য সমুদ্র তীরে সূর্যাস্ত দেখা। যথারীতি সমুদ্রের তীরে চলে গেলাম। অপরাহ্নে সমুদ্র তীরের মৃদু মন্দ বাতাস আমাদের শরীর মন জুড়িয়ে দিচ্ছিলো। পুরো বিকেলটা সমুদ্রে কাটিয়ে সূর্যাস্ত দেখে সন্ধ্যার দিকে আমরা হোটেল রুমে ফিরে এলাম।

বস ঘোষণা দিলেন রাতের খাবার খেয়ে সবাইকে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে হবে কারণ খুব ভোরেই আমরা টেকনাফের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। হোটেলেই আমরা রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। তখনি আতাউরের মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি আসলো। আমাদেরকে বললো,”চল সমুদ্রের রাতের রুপটা দেখে আসি”। বু্দ্ধিটা খারাপ না তবে বস যদি জানতে পারে তাহলে প্রলয় শুরু হয়ে যাবে। তাই প্লান করলাম সবাই ঘুমিয়ে পড়লে চুপি চুপি আমরা চার বন্ধু বেরিয়ে পড়বো। যেই ভাবা সেই কাজ।

সবাই ঘুমিয়ে পড়তেই আমরা চুপিসারে বেড়িয়ে পড়লাম। সাগর পাড়ে গিয়ে আমরা পুরো অবাক। দিনের বেলায় সমুদ্রের যেই রুপ আমরা দেখেছিলাম এখন যেনো দেখছি তা যেনো একদম ভিন্ন এক রুপ। দিনের বেলা জোয়ার ছিলো এখন ভাটা চলছে। ভাটাতে সমুদ্র অনেকটা শুকিয়ে যায়। পাড় ধরে হেটে হেটে আমরা সমুদ্রের মোটামুটি মাঝখানে চলে গেলাম। চাঁদের আলো যখন বালুর উপরে পড়ছিলো বালু্কণা গুলো তখন চিকচিক করছিলো।

আজ চন্দ্র মাসের ১৪ তারিখ। কাল ১৫ তারিখ ভরা পূর্ণিমা, চাঁদের আলো আজকে যতোটা সুন্দর দেখাচ্ছে কাল সেই সৌন্দর্য্য কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। আর চাঁদের সেই অপরুপ সৌন্দর্য্য টা আমরা সেন্টমার্টিন দ্বীপে গিয়ে উপভোগ করতে পারবো সেটা ভাবতেই একটা রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। সাগর পাড়ে হাটাহাটি করতে করতে কখন যে রাত দুটো বেজে গেছে কারোরই খেয়াল ছিলো না। রাত অনেক হয়েছে বেশিক্ষণ আর থাকা যাবে না। একটু ঘুমানো দরকার। সবাই তখন হোটেল রুমে ফিরে গেলাম। হোটেলে গিয়েই মনে হলো কক্সবাজার থেকে কেনাকাটা করা হলো না। হাসান তখন বলে উঠলো,” সমস্যা নাই সেন্টমার্টিন গিয়ে পুষিয়ে নিবো”।

২৮ তারিখ, ভোর ৬টা
হোটেল রুম থেকে চেক আউট করে আমরা সবাই বাসে উঠে পড়লাম। গন্তব্য টেকনাফ। টেকনাফ গিয়ে নাস্তা করবো। ৯টায় আমাদের শিপ ছাড়বে। তাই ঝটপট সবাই বেড়িয়ে পড়লাম। বাসে আমরা চার বন্ধু জিমুচ্ছি। গতকাল রাতে যে আমরা কতো ইতিহাস করেছি সেটা কেউ বুঝতে পারে নি। অন্যেরা সবাই গান বাজনায় বাসটা মাতিয়ে তুলেছে। ঘুম ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে আমরাও গানে শরিক হচ্ছিলাম।

মেরিন ড্রাইভ হয়ে আমাদের বাস টেকনাফের উদ্দেশ্য ছেড়ে যাচ্ছে। এক পাশে সাগর আরেক পাশে পাহাড়। এ যেনো এক নৈস্বর্গিক দৃশ্য।

মেরিন ড্রাইভের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে আমাদের বাস যখন কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প অতিক্রম করছিলো তখন ঘটলো বিপত্তি। বিকট এক শব্দে সবাই নড়ে চড়ে উঠলাম। বাস থেকে নেমে দেখলাম টায়ার পান্চার। যে জায়গায় টায়ার পান্চার হলো তার পাশেই ছিলো রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ক্যাম্প। বাস থেকে আমাদের নামতে দেখে রোহিঙ্গা শিশুরা চারপাশ থেকে আমাদের ঘিরে ধরলো। তাদের সাথে কিছু সুন্দর সময় কাটালাম। শুনলাম তাদের কষ্টের কাহিনী কিভাবে অত্যারের শিকার হয়ে মাতৃভুমি ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমাদের সাথে থাকা কিছু খাবার বাচ্চাদের দিলাম। এদিকে শিপ ছাড়তে সময় বাকি ১ ঘন্টা। তখন বাধ্য হয়ে দুটো লেগুনা ভাড়া করে টেকনাফ চলে গেলাম।

বাস ড্রাইভার কে বলা হলো গাড়ি সারিয়ে যেনো টেকনাফ চলে আসে। টেকনাফ গিয়ে নাস্তা সেরে শিপে উঠে পড়লাম। কেয়ারি সিন্দাবাদ শিপটা আমাদের নিয়ে নাফ নদীর বুক চিরে পাড়ি দিচ্ছে আমাদের স্বপ্নের গন্তব্য সেন্টমার্টিন দ্বীপে।

শিপে করে সেন্টমার্টিনে পাড়ি জমিয়েছে সকল বয়সের মানুষ। সবার চেহারায় ফুটে উঠেছে এক অন্য রকম অনুভুতি। শিপেও চললো আরেক দফা গান বাজনা। শিপ যখন মাঝ নদীতে তখন শিপের চারপাশে নজরে আসলো এক ঝাঁক গাঙচিল। পর্যটকেরা গাঙচিলদের উদ্দেশ্য চিপস ছুড়ে মারছে আর চিলগুলো সেই চিপস গুলো ঠোট দিয়ে ক্যাচ করে নিচ্ছে। সে এক অপরুপ দৃশ্য! গাঙচিলদের সাথে খেলতে খেলতে নাফ নদীর স্বচ্ছ নীল জল পাড়ি দিয়ে আমরা মাঝ দুপুরে পৌছে গেলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেটিতে।

দুপুর ১.৩০ মিনিট, সেন্টমার্টিন দ্বীপ
দুপুর ১.৩০ মিনিটে আমাদের জাহাজ সেন্ট মার্টিন জেটিতে এসে ভীড়লো। যথারীতি আমরা জাহাজ থেকে নেমে আগে থেকেই বুকিং করা আমাদের হোটেল রুমের দিকে ছুটলাম। হোটেল রুমে গিয়ে ব্যাকপ্যাক রেখে ছুট্লাম সমুদ্রের তীরে গা ভেজাতে।

সমুদ্রের সামনে গিয়ে যখন পৌছালাম কিছুক্ষণের জন্য যেনো হতবাক হয়ে পড়লাম। এতো সুন্দর নীল স্বচ্ছ পানি মনে হচ্ছিলো আমরা যেনো মায়ামি বিচে চলে এসেছি। কক্সবাজারের পানি দেখে যতোটা বিরক্ত হয়েছিলাম এখানে এসে ততোটাই অবাক হয়েছি! তাই আর দিক বেদিক না তাকিয়ে দৌড়ে গিয়া ঝাপ দিলাম সাগরের নীল স্বচ্ছ পানিতে।

অতঃপর যা ঘটার তাই ঘটলো। ধারালো শৈবালের আঘাতে আমার পায়ের বিশাল একটা অংশ কেটে গেলো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে কোনো ব্যাথা অনুভুত হচ্ছিলো না। হয়তো পানির লবণাক্ততার কারণে কাটা জায়গায় তেমন জ্বলন অনুভুত হচ্ছে না।

আমরা একদল সাগরে গা ভিজাচ্ছিলাম উপরে আরেকদল ফুটবল খেলছিলো। যারা কখনো ফুটবল খেলেনি সেন্টমার্টিন এসেও তারাও একেক জন মেসি রোনাল্ডো হয়ে উঠেছে। প্রায় দুই ঘন্টার মতো সমুদ্রে কাটিয়ে সবাই হোটেলে ফিরলাম।

ততোক্ষণে সবাই প্রচন্ড খিদে অনুভব করছিলাম। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে সেন্টমার্টিন বাজারে চলে গেলাম পায়ে ব্যান্ডেজ করাতে। পায়ে ব্যান্ডেজ করে সবাই যে যার মতো পুরো দ্বীপটা ভ্রমণে বেড়িয়ে পড়লাম। কেউ বা আবার সাইকেলে করে দ্বীপে চক্কর দিচ্ছে। তবে আমরা হেটে হেটেই দ্বীপটা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। দ্বীপের মানুষের জীবন-যাত্রা, তাদের সরলতা সব কিছুই আমাদের মুগ্ধ করছিলো।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি ছোট প্রবাল দ্বীপ। আয়তনে মাত্র ৮ বর্গকিলো মিটারের এই দ্বীপটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ও মায়ানমার-এর উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত।

প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলে থাকেন। আমাদের মতো সমুদ্রপ্রেমীদের কাছে এটি ব্যাপক পরিচিত একটি নাম। বিখ্যাত লেখক, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ স্যারের দারুচিনি দ্বীপ নামের পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি দ্বারা এই দ্বীপটির পরিচিতি আরো বেড়ে যায়। কবে প্রথম এই দ্বীপটিকে মানুষ শনাক্ত করেছিল তা জানা যায় নি। প্রথ্মে কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। যার অর্থ আশ্রয় স্থল।

উল্লেখ্য আরব বণিকেরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিতে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতো। কালক্রমে চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মানুষ এই দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামেই চিনতো। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপে বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবী।

যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ। কালক্রমে এই দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। আগে থেকেই এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল।

সম্ভবত বাঙালি জেলেরা জলকষ্ট এবং ক্লান্তি দূরীকরণের অবলম্বন হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ এই দ্বীপে রোপণ করেছিল। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় 'নারকেল গাছ প্রধান' দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ব্রিটিশ ভূ-জরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসাবে গ্রহণ করে। জরিপে এরা স্থানীয় নামের পরিবর্তে খ্রিষ্টান সাধু মার্টিনের নামানুসারে সেন্টমার্টিন নাম প্রদান করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্টমার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে।

সেন্টমার্টিন্স দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১শ ৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১শ ৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১শ ৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২শ ৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১শ ২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়।

দ্বীপের চার পাশটা ঘুরতে ঘুরতে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এলো খেয়ালই ছিলো না। সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনা শেষ করে সবাই সাগর পাড়ে জোসনা দেখার প্রিপারেশন নিচ্ছিলাম। সাথে চলছিলো সামুদ্রিক মাছের বারকিউ আয়োজন।

বাজার থেকে আমরা সবাই গিয়ে কোরাল মাছ কিনে আনলাম। হোটেলের সামনে চলছে বারবিকিউ। একপাশে আমরা বারবিকিউ করছি। অপর পাশে বসেছে গানের আসর। গানের গানের তালে তালে বারবিকিউ চলছিলো। সেই আনন্দঘন অনুভুতি গুলো লিখে প্রকাশ করা যাবে না। যথারীতি রাত ১০টার মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ করে মহাসমারোহে আমরা চলে গেলাম সমুদ্রের তীরে।

উদ্দেশ্য সমুদ্রের তীরে বসে জোসনা দেখবো। যেই জোসনা দেখার জন্য আমাদের এতো প্রতিক্ষা! যার জন্য আমাদের এতো দূর ছুটে আসা।

রাতে ভাটা হওয়ার কারণে পানি অনেকটা শুকিয়ে গিয়েছিলো। তাই আমরা সমুদ্রের অনেকটা নিকটে যেতে পেড়েছি। শৈবালে বসে চাঁদের আলোয় গান চলছিলো। মনে হচ্ছিলো সময়টা যেনো থেমে গিয়েছে। অনন্ত কাল ধরে যেনো আমরা এখানে বসে আছি। সমুদ্রের গর্জনের সাথে মৃদু বাতাস আমাদের মাতাল করে দিচ্ছিলো।

এই দ্বীপে বসবাসরত মানুষ গুলো কতোটা সৌভাগ্যবান! সমুদ্রের সাথে গড়ে উঠেছে তাদের মিতালি। যেই সমুদ্র আমাদের আনন্দের যোগান দেয় সেই সমুদ্রই তাদের যোগান দেয় জীবিকার। মনে হচ্ছিলো যেনো জীবনের সেরা মুহূর্ত গুলো কাটাচ্ছি সমুদ্রের তীরে বসে।

ভাবছি যদি সমস্ত পিছুটান ছেড়ে এই দ্বীপে ছোট্ট একটা ঘর বাঁধতে পারতাম। প্রতিদিন মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতাম এবং রাত হলে সমুদ্রের তীরে উপভোগ করতাম সাগরের এই নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্য। কিন্তু সভ্য সমাজের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো যা করতে ইচ্ছে করা তা করা যায় না। আমার সেই ইচ্ছাটাও হয়তো অপূর্ণ্যই থেকে যাবে। গানবাজনা শেষ করে আমরা ৪ বন্ধু সাগর পাড়ের রাতের সৌন্দর্যটা উপভোগ করছিলাম।

হেটে বেড়াচ্ছিলাম সমগ্র দ্বীপ জুড়ে। হাটতে হাটতে দ্বীপটা প্রায় ঘুরে শেষ করে ফেলেছি। আমরা যখন হোটেল রুমে ফিরছিলাম সময় তখন ভোর ৪ টা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

২৯ তারিখ, ভোর ৫টা
খুব ভোরেই এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম যাতে সাগরের তীরে বসে সকালের সূর্যদয়টা মিস না হয়। ঘুম থেকে উঠে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আমরা ছুটে চললাম সাগর তীরে। সোনালী কিরণ ছড়িয়ে সূর্যি মামা যখন পূর্ব আকাশে উদিত হচ্ছিলো তখন চারপাশের একটা স্বর্গীয় আবহাওয়া বিরাজ করছিলো তার অনুভুতিটা প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা হয়তো আজও পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়নি।

সূর্যদয় দেখা শেষ করে ছুটলাম দ্বীপের উত্তর পশ্চিম কোনে । সেখানে ভীরে আছে অনেক গুলো সাম্পান। জেলেরা সপ্তাহ খানেক পরে সাগর থেকে ফিরে এসেছে মাছ শিকার করে। একদল জেলে সেই মাছ গুলো ট্রলার থেকে নামাচ্ছে। আরেক দল মাছ গুলো বেছে আলাদা করছে বাজারে তোলার জন্য। পাশেই দেখলাম একদল দ্বীপ বাসী মাছের শুটকি দিচ্ছে।

তাদের পেশাই হলো শুটকি বানানো। মনে মনে ভাবছিলাম যাওয়ার সময় এখান থেকে শুটকি নিয়ে যাবো। তখনি আমাদের ডাক পড়লাম হোটেল রুমে নাস্তার জন্য। প্লান হয়েছে নাশতা করে ছেড়াদ্বীপ যাওয়া হবে। যথারীতি নাশতা শেষ করে সবাই জেটিতে ফিরে এলাম। জেটিতে আগে থেকেই ট্রলার ভাড়া করা ছিলো।

ট্রালারে উঠে নীল জল পাড়ি দিয়ে ছুটে চলেছি ছেড়াদ্বীপের পথে। ছেড়াদ্বীপ হলো বাংলাদেশের শেষ সীমানা। তারপরে আর বাংলাদেশের সীমানা নেই। এর পর থেকেই মায়ানমারের ভুখন্ড শুরু।

সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়া দ্বীপ পৌছাতে সময় লাগে ৩০ মিনিট। ছেড়া দ্বীপের সৌন্দর্য্য টাও দারুণ। সেখানে রয়েছে অনেক শৈবাল এবং গাছ গাছালি। খুব সাবধানে ধারালো শৈবাল গুলো পাড়ি দিয়ে দ্বীপের সৌন্দর্য্য উপভোগ করে চলেছি।

তখন বস ঘোষণা দিলেন এখানে হাডুডু খেলা হবে। বিজয়ীর জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় পুরস্কার। সবাই খেলায় অংশগ্রহণ করলাম এবং সবাই গো হারা হেরে গেলেও বন্ধু ফয়সাল জিতে নিলো বিজয়ীর পুরস্কার। ছেড়াদ্বীপে কাটানো মুহূর্ত গুলো ক্যামেরা বন্দী করে আমরা আবার ব্যাক করলাম সেন্টমার্টিনে। হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।

৩টায় ছিলো আমাদের শীপ। হাতে এক ঘন্টা সময় পেয়েছি। এই সময়টাতে জমিয়ে শপিং করবো সবাই। যথারীতি যে যার মতে শপিং শুরু করলাম। নিলাম সামুদ্রিক মাছের শুটকি, বাচ্চাদের জন্য চকোটেল বার্মিজ আচার, হালকা কিছু জিনুকের গহনা।

শপিং শেষ করে সবাই শীপে উঠে পড়লাম। ৩ টা বাজে আমাদের শিপ ছেড়ে দিলো। শীপে উঠেই সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ৬ টার দিকে আমাদের শিপ টেকনাফ এসে পৌছালো। পান্চার সারিয়ে আমাদের বাস আমাদের জন্য টেকনাফে অপেক্ষা করছিলো। সবাই বাসে উঠে পড়লাম। আর তখনি বুকের বাম পাশটা মোচর দিয়ে উঠলো।

মনে হচ্ছিলো ছোট্ট এই দ্বীপটাতে কী যেনো ফেলে যাচ্ছি! মনের গভীরে বিশাল এক শূন্যতা অনুভব করছিলাম। ২ দিনের ছোট্ট এই সফরে দ্বীপটা এবং দ্বীপের সহজ সরল মানুষ গুলো যেনো আপন হয়ে উঠেছে। আপনজনের কাছ থেকে দূরে সরে গেলে যেই কষ্ট অনুভুত হয় এখনো ঠিক সেই কষ্টটাই যেনো পাচ্ছি।

সারা বছরের কর্মব্যাস্ততা শেষে একটা রিফ্রেশমেন্ট দরকার ছিলো। সেন্টমার্টিনের দ্বীপের এই ট্যুরটা যেনো আমাদের সারা বছরের স্ট্রেস কে এক নিমিষেই দূর করে দিয়ে সামনের দিন গুলোতে নতুন উদ্দোমে কাজ করার জন্য পাথেয় হিসেবে সঞ্চারিত হয়েছে। আমাদের সেন্টমার্টিন দ্বীপে অভিযানের ছোট্ট গল্পটা এখানেই শেষ। ফিরে যাচ্ছি গতানুগতিক নাগরিক ব্যস্ততার ভীরে। হয়তো ব্যস্ত জীবনের কাজের ফাঁকে হঠাৎ করে মনে পড়বে দ্বীপে মাঝে জোসনা দেখার স্মৃতি গুলো, হয়তো মনে পড়লো অচেনা এক দ্বীপের মানুষ গুলো কিভাবে আমাদেরকে আপন করে নিয়েছিলো সেই অনুভুতি গুলো। ফিরে যাচ্ছি চেনা শহরে নতুন কোনো অনুভুতির খোঁজে…

লিখেছেন: মো: রফিকুল ইসলাম
ইউটিউব কন্টেন ক্রিয়েটর
নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ থেকে

আরো দেখুন

দৃষ্টি আকর্ষণ: আমাদের পর্যটন স্পট গুলো আমাদের দেশের পরিচয় বহন করে এবং এইসব পর্যটন স্পট গুলো আমাদের দেশের সম্পদ। এইসব স্থানের প্রাকৃতিক কিংবা সৌন্দর্য্যের জন্যে ক্ষতিকর এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন। আর ভ্রমনে গেলে কোথাও ময়লা ফেলবেন না। দেশ আমাদের, দেশের সকল কিছুর প্রতি যত্নবান হবার দায়িত্বও আমাদের।
ভ্রমণকাল: আমাদের টিম সবসময় চেষ্টা করে আপনাদের কাছে হালনাগাদ তথ্য উপস্থাপন করতে। যদি কোন তথ্যগত ভুল কিংবা বানান ভুল হয়ে থাকে বা ভ্রমণ স্থান সম্পর্কে আপনার কোন পরামর্শ থাকে অথবা আপনার কোন ভ্রমণ গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করতে চান তাহলে Comments করে জানান অথবা আমাদের কে ''আপনার মতামত'' পেজ থেকে মেইল করুন।